আবারও অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনায় ভারত

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ‘খুবই ভালো’ আছে বলে বিবিসি বাংলার কাছে সম্প্রতি দাবি করলেও ভারত বিভিন্ন ইস্যুতে আবারও অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে বুঝিয়ে দিল, তারা সেই বক্তব্যের সঙ্গে মোটেই সহমত নয়।
শুক্রবার (৭ মার্চ) দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে ভারত সরকার যা যা বলেছে– তার কোনওটাই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য প্রশংসাসূচক নয়।
সম্প্রতি ভারতের আমন্ত্রণে দ্বিপাক্ষিক স্তরে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে যে সব বৈঠক হয়েছে, সেগুলোকেও ‘রুটিন বৈঠক’ বলে বর্ণনা করে সেগুলোর গুরুত্ব খাটো করে দেখাতে চেয়েছে ভারত।
অর্থাৎ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ভারতের দিক থেকেও তাগিদ আছে, বিষয়টাকে যাতে সেভাবে ব্যাখ্যা না করা হয়, মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালের কথাতে পরিষ্কার সেই ইঙ্গিত ছিল।
ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্নেও দিল্লির অবস্থান যে ‘আগের মতোই’ আছে – সেটাও জানিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলে ভারত মনে করছে না, মুখপাত্রের কথা থেকে তা কার্যত স্পষ্ট হয়ে গেছে।
‘পলাতক একটি দল’ বিদেশ থেকে প্ররোচনা দিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ‘আনসেটল’ করতে চাইছে বলে প্রধান উপদেষ্টা যে অভিযোগ করেছেন, সাংবাদিক সম্মেলনে মুখপাত্র অবশ্য ‘অন রেকর্ড’ তার কোনও জবাব দেননি।
যে সব ইস্যুতে সমালোচনা
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে ‘কোনও অবনতি হয়নি’ এবং ‘সম্পর্ক সব সময় ভালো আছে’ বলে সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তবে ভারতের পক্ষ থেকে আজ (শুক্রবার) কার্যত স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে গতিপ্রকৃতি, তাতে ভারতের দৃষ্টিতে অন্তত কোনও পরিবর্তন আসেনি।
এদিন ভারত সরকারের অন্তত তিন-চারটি বক্তব্য থেকে তাদের এই মনোভাব পরিষ্কার হয়ে গেছে। কয়েক মাস আগেও তারা এই প্রশ্নগুলোতে যে সুরে কথা বলেছিলেন, আজও অবিকল সেই ভাষা ও ভঙ্গিতেই অভিযোগগুলোর পুনরাবৃত্তি করেছেন।
প্রথমত, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল শুক্রবার সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে আবারও বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু-সহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় ভারত চিন্তিত। তিনি জানান, গতবছরের ৬ অগাস্ট থেকে এ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর সে দেশে যে ২৩৭৪টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে মাত্র ১২৫৪টি পুলিশ যাচাই করেছে এবং এর মধ্যেও ৯৮ শতাংশ হামলাই রাজনৈতিক চরিত্রের বলে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্য সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি ও ধর্মীয় উপাসনালয় রক্ষার দায়িত্ব যে অন্তর্বর্তী সরকারের, সে কথা আমরা বারবার বলে আসছি। এই ধরনের কোনও হামলাকে রাজনৈতিক বলে চিহ্নিত না-করে সব হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার সব ঘটনাতেই দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে, এটাই আমরা আশা করব। বাংলাদেশের হিন্দুদের পরিস্থিতি সে দেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ এবং ভারতের তাতে নাক গলানোর কোনও দরকার নেই বলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মহম্মদ তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছেন, সেই বক্তব্যও নাকচ করে দিয়েছেন তিনি।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ক্রমশ অবনতি’তে ভারত যে উদ্বিগ্ন– এ কথাও আজ জানানো হয়েছে। সেখানে গুরুতর অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত উগ্রপন্থী লোকজনকেও যেভাবে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ ও ‘সবার অংশ গ্রহণের ভিত্তিতে’ হওয়া দরকার বলেও ভারত এদিন মন্তব্য করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এই ধরনের একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই ও ‘গণতান্ত্রিক পন্থা’তে সেখানে যাবতীয় ইস্যুর মীমাংসা করা দরকার – যেটা এই মুহুর্তে হচ্ছে না বলে তারা মনে করছে।
১৯৯৬ সালে দিল্লিতে গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা
‘এগুলো রুটিন বৈঠকের বেশি কিছু নয়’
সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা চুক্তি-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির এবং উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক দুটো হয়েছে, তাকেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে রাজি হয়নি ভারত। এই দুটোকেই মুখপাত্র ‘নিয়মিত রুটিন বৈঠক’ বলে বর্ণনা করেছেন।
গঙ্গা-সংক্রান্ত বৈঠকের ক্ষেত্রে বলেছেন, ১৯৯৬র গঙ্গা চুক্তিতে বিধান আছে বছরে তিনটে এই ধরনের টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক হতে পারে। এছাড়া ভারতের উন্নয়ন সহায়তায় বাংলাদেশে যে সব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হয়ে থাকে, দিল্লিতে সম্প্রতি সেই সংক্রান্ত আর একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ‘নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণেই’ যে ভারতের বহু উন্নয়ন প্রকল্প সে দেশে থমকে আছে– এই পটভূমিতে সেই অভিযোগেরও পুনরাবৃত্তি করেছেন রণধীর জয়সওয়াল।
বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার কার্যক্রম যে চট করে স্বাভাবিক হচ্ছে না, তার কথায় সেই আভাসও ছিল। ভিসাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি তো জানি বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা ভিসা পাচ্ছেন। মেডিক্যাল ভিসাও দেওয়া হচ্ছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যর প্রতিক্রিয়ায়
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যে প্রসঙ্গগুলোর অবতারণা করেছিলেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে সরাসরি বা ‘অন রেকর্ড’ তার কোনও জবাব দেননি মুখপাত্র।
যেমন পলাতক আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিদেশ থেকে প্ররোচনা দিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ‘আনসেটল’ বা অস্থির করতে চাইছে – প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এমন অভিযোগও তুলেছিলেন। তবে দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় একটি সূত্র বিবিসি বাংলাকে আভাস দিয়েছেন, তারা এই বক্তব্যের সঙ্গে আদৌ একমত নন। তার কথায়, উনি কি শেখ হাসিনার কথা বলতে চাইছেন? তাহলে নাম করে পরিষ্কার বলছেন না কেন? আর শেখ হাসিনাকে তো ওনারা বিচারের জন্য ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেছেন – আমরা আগেই বলেছি সেই চিঠি পেয়েছি, চিঠির বক্তব্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমাদের সেই আগের অবস্থানই বহাল আছে, ফলে এখন আর সেটা নিয়ে কথা বলা সমীচীন নয়।
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকই আছে, প্রধান উপদেষ্টার এই মূল্যায়নের সঙ্গে ভারত কি একমত? এই প্রশ্নের জবাবে ওই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আমরা কী ধরনের বাংলাদেশ দেখতে চাই, কেন চাই- বাংলাদেশ স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রগতিশীল হোক, তা আগেও অজস্রবার বলেছি, এখনও তাই বলছি। এ বিষয়ে নতুন করে আমাদের আর কিছু বলার আছে বলে মনে করি না!