আইনসভা: সংসদের উচ্চকক্ষ

দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার আলাপ বহু দিনের। এ ধরনের আইনসভা ভারতে যেমন আছে; তেমনি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বহু দেশে আছে। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর ৪১ শতাংশ দেশেই দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা প্রচলিত। দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সুবিধা অনেক। সরকার চাইলেই নিজেদের স্বার্থে বিনা বাধায় বাকশালের মতো গণবিরোধী আইন তিন মিনিটে পাস করে ফেলতে পারে না। চাইলেই বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করে দিয়ে গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরতে পারে না। নিম্নকক্ষে কোনো প্রস্তাব আলোচনা-সমালোচনার পর অনুমোদিত হলে ভেটিংয়ের জন্য উচ্চকক্ষে উপস্থাপন করা হয়। সেখানে ফের এর যৌক্তিকতা আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়। উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে প্রস্তাবটি পাস হলেই তা আইনে পরিণত হয়। দুই কক্ষে যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা থাকার ফলে একটি প্রস্তাবের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকে। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে মানুষ বিষয়টির ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পায়। গণবিরোধী আইন সরকার পাস করতে চাইলে জনগণ রাজপথে নেমে আন্দোলন করারও সুযোগ পায়। ফলে তাড়াহুড়ো করে ভুল এবং জাতির জন্য আত্মঘাতী আইন পাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এখন আলোচনা করা যাক, আমাদের দুই কক্ষের ধরন কেমন হবে। নামই কী হবে। জাতীয় সংসদের নির্বাচন কেমন হবে? প্রতিটি দল তাদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে; একটি রাজনৈতিক দল সারাদেশ থেকে মোট যত শতাংশ ভোট পাবে, তত শতাংশ আসন তারা সংসদে পাবে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের রীতি অনুযায়ী যারা সংগরিষ্ঠতা পাবেন, তারাই সরকার গঠন করবেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন যারা পাবেন, তারা হবেন প্রধান বিরোধী দল। অন্য দলের সদস্যরা চাইলে সরকার এবং বিরোধী দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে পারেন, আবার আলাদাভাবে সংসদে প্রতিনিধিত্বও করতে পারেন।
এবার আসি উচ্চকক্ষের ধরন ও ধারণা নিয়ে। উচ্চকক্ষের নাম ‘জাতীয় আইনসভা’ বা ‘জাতীয় আইন পরিষদ’ হতে পারে। পৃথিবীর বহু দেশে যেহেতু উচ্চকক্ষ আছে; সেসব দেশের মধ্যে যেটি আমাদের জন্য উপযুক্ত তেমন একটি মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। কিছু কিছু দেশের মডেল সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। আমার নিজস্ব একটি চিন্তাও আছে, সেটি হয়তো কোনো একটি দেশের বা একাধিক দেশের সঙ্গে মিলে যেতেও পারে।
আমার ব্যক্তিগত মত হলো, উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ৮০ হতে পারে। প্রতি জেলা থেকে একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি, ছয়জন ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসী প্রতিনিধি, পাঁচজন তৃতীয় লিঙ্গ এবং নারী প্রতিনিধি এবং পাঁচজন হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। এই সংখ্যা অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য অনুপাতেও বিন্যাস করা যেতে পারে।
সংবিধানে একজন উপরাষ্ট্রপতির পদ তৈরি করতে হবে। উপরাষ্ট্রপতি আইনসভায় সভাপতিত্ব করবেন। আইনসভার একমাত্র কাজ হবে সংসদে পাস হওয়া বিলগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করে অনুমোদন বা বাতিল করা। সংসদে পাস হওয়া কোনো বিল যদি আইনসভা বাতিল করে দেয়, সরকার চাইলে সেই বিলের পক্ষে- বিপক্ষে গণভোটের আয়োজন করতে পারে অথবা অর্ডন্যান্স জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করতে পারেন তা আইনে পরিণত করতে। এ ধরনের ঘটনা কালেভদ্রে এক-আধটা ঘটতে পারে এবং এ জন্য সরকার সর্বদা সমালোচিত হবে এবং তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাবে।
আইনসভা বা উচ্চকক্ষের নির্বাচন হবে দুই সংসদ নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে। আমি প্রস্তাব করছি, সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করা হোক। আইনসভার সদস্যদের মেয়াদও চার বছর হবে। সরকারের বয়স দুই বছর হলে আইনসভার নির্বাচন হবে। এ ব্যবস্থার সুবিধা হলো এই, যে সরকারের অধীনে আইনসভার নির্বাচন হবে, তারা সেই নির্বাচিত আইনসভার সুবিধা মাত্র শেষের দুই বছর নিতে পারবে। সরকারের প্রথম দুই বছর পূর্ববর্তী সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আইনসভার মুখোমুখি হতে হবে। এতে ক্ষমতার একটি ভারসাম্য নির্ণীত হবে।
যদি দেখা যায়, মধ্যবর্তী নির্বাচনগুলো খুব স্বচ্ছ হচ্ছে, তাহলে এক সময় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে হয়তো বেরিয়ে আসা যাবে। তবে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে। এভাবে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ক্রমেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে।
কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি ও জাতিসংঘ কর্মকর্তা