অস্ত্রবিরতিতে থামল যুদ্ধের দামামা

ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোনের চার দিনের লড়াই থামল। অস্ত্রবিরতিতে রাজি হলো ভারত ও পাকিস্তান। রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মতো আরও এক যুদ্ধের আশঙ্কা থেকেও আপাতত মুক্তি পেল দক্ষিণ এশিয়া।
তবে অস্ত্রবিরতিতে গেলেও থেমে নেই দুপক্ষের মধ্যেকার বাগ্যুদ্ধ। ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান অস্ত্রবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের দাবি, তারা কোনোভাবেই অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করেনি।
বিবিসি ও বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, শনিবার (১০ মে) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যে প্রথম ভারত ও পাকিস্তানের অস্ত্রবিরতিতে যেতে সম্মতির তথ্য প্রকাশ পায়। সন্ধ্যার পর কার্যকর হয় দুই প্রতিবেশী দেশের যুদ্ধংদেহী মনোভাবে বিরতি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার বৈরী সম্পর্কে সংঘাত স্বাভাবিক ঘটনা। সাতচল্লিশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে দুই দেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সংঘাতে জড়িয়ে আসছে। একাধিকবার যুদ্ধও হয়েছে। তবে এবারই দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘাত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। অস্ত্রবিরতির মধ্য দিয়ে আপাতত সে সংঘাতের ইতি ঘটল।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে রাজি: ট্রাম্প
এর আগে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতির কথা জানিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোস্যালে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাতে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনার পর আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা দিচ্ছি যে ভারত ও পাকিস্তান অবিলম্বে একটি পূর্ণ অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয়েছে।’
ট্রাম্পের এ ঘোষণার পর ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একই তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করে। জানায়, তারা শান্তির পক্ষে রয়েছে।
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার সঙ্গে আপস করা ছাড়া পাকিস্তান সবসময় এ অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, ভারতের স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা থেকে দুই দেশ স্থল, বিমান ও নৌ পথে হামলা বন্ধ রাখতে রাজি হয়েছে। সোমবার (১২ মে) দুপক্ষ ফের আলোচনায় বসবে।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর খবর, অস্ত্রবিরতির ঘোষণা আসার পর নয়া দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন করেন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, অস্ত্রবিরতির চুক্তি নয়া দিল্লি গ্রহণ করেছে। তবে দেশ রক্ষায় তারা সজাগ থাকবে।
এদিকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পরই নিজেদের আকাশসীমা সব ধরনের ফ্লাইটের জন্য খুলে দেয় পাকিস্তান এয়ারপোর্ট অথরিটি (এপিএ)।
অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ, পাকিস্তানের অস্বীকার
এদিকে অস্ত্রবিরতির সমঝোতা হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান বার বার তা লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি শনিবার গভীর রাতে দিল্লিতে এক জরুরি সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে অস্ত্রবিরতির সমঝোতা হয়েছে, তা গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান দফায় দফায় লঙ্ঘন করেছে।
ভারত এই যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘনকে খুব ‘গুরুত্বের সঙ্গে’ নিয়েছে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী এর ‘যথোচিত জবাব’ দিচ্ছে বলেও জানান ভারতের পররাষ্ট্র সচিব।
স্থানীয় গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, অস্ত্রবিরতিদে দুই দেশ সম্মত হওয়ার খবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ভারতশাসিত কাশ্মিরের নানা জায়গা থেকে এবং ভারতের পশ্চিম সীমান্ত বরাবর বিভিন্ন জায়গা থেকে বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যায়।
ভারতশাসিত জম্মু ও কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ একপর্যায়ে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্টও করেন এ নিয়ে। বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি তো নেই মনে হচ্ছে!’
পাকিস্তান অবশ্য অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দেশটির তথ্যমন্ত্রী আত্তাউল্লাহ তারার পাকিস্তানের একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেন, ‘পাকিস্তান অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করতে পারে না এবং তারা তা করার কথা ভাবেওনি।’
‘পাকিস্তানে উৎসবের পরিবেশ বিরাজ করছে। পাকিস্তান যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, এটি আমাদের জন্য একটি বিজয়,’— বলেন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন ও বানোয়াট’ বলেও দাবি করেন তিনি।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই সংঘাতের সূত্রপাত গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাশ্মিরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায়। ওই হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছিলেন। ভারতের দাবি ছিল, পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদতে জঙ্গিরা এ হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানও ওই হামলায় যেকোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে।
এ ঘটনার জের ধরে কাশ্মির সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে টানা কয়েকদিন ধরে বিচ্ছিন্নভাবে গোলাগুলি হয়। পরে গত বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নাম দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। জবাবে পাকিস্তানও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরসহ পাঞ্জাব ও গুজরাটসহ বিভিন্ন রাজ্যে গোলাবর্ষণ, ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ও ড্রোন হামলা শুরু করে।
দুই দেশই প্রতিপক্ষের বায়ু প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে সামরিক ঘাঁটিতে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি করার দাবি করেছে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বেসামরিক স্থাপনা ও জনগণের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগও রয়েছে।
এসব হামলা-পালটা হামলা ও অভিযোগ-পালটা অভিযোগের মধ্যে চার দিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতিতে গেল দুই দেশ।
দুই দেশের এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এক্স হ্যান্ডেলে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ‘শান্তির পথ বেছে নেওয়ায় আমরা প্রধানমন্ত্রী মোদি ও শরিফের রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার প্রশংস করি।’
তিনি নিজে ও যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স আগের ৪৮ ঘণ্টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফসহ ঊর্ধ্বতন ভারতীয় ও পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কাটিয়েছেন বলেও জানান রুবিও।