প্যারিস অলিম্পিক যেন বিশ্ব ক্রীড়াবিদদের মিলনমেলা

চার বছর বিরতি দিয়ে হওয়া এই একমাত্র গেমসটি পুরো বিশ্বকে এক করে দিচ্ছে। প্রায় তিন সপ্তাহ ক্রীড়াবিদরা বুদ হয়ে থাকেন। জমজমাট মিলনমেলায় পরিণত হয় আয়োজক প্যারিস শহরটি। যেখানে কোনও জাতপাত কিংবা বর্ণ বৈষম্য নেই। এবার অংশ নিচ্ছে রিফিউজি অলিম্পিক টিম। ১১ দেশের ৩৭ জন অ্যাথলেট ১২টি বিভিন্ন খেলায় অংশ নিচ্ছেন।
ধরুন বিশ্বকাপ ফুটবল আসলেই সবাই বুদ হয়ে পড়েন। মেতে ওঠেন চর্মগোলকের উৎসবে। তবে সেখানে বাছাইপর্ব পেরিয়ে নির্দিষ্ট দল খেলে থাকে। সেই আকর্ষণ আবার অন্য রকম। তবে অলিম্পিকে আবার নির্দিষ্ট কোনও দেশ নয়, সব দেশের প্রতিনিধিত্ব থাকে। এই যেমন প্রতিটি দেশই কোনও না কোনও ডিসিপ্লিনে খেলছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি এতদিন ধরে এমনটাই নিশ্চিত করে আসছে। সবচেয়ে বড় বিষয় যেসব দেশের ক্রীড়াবিদরা সরাসরি খেলার সুযোগ পায় না তারা ওয়াইল্ড কার্ড পেয়ে থাকেন। যেন সব দেশের অংশগ্রহণে গেমসটি রঙিন হয়।
এছাড়া সাম্য, সৌহার্দ্য আর ভালোবাসার এক গেমস আয়োজনই বড় বিষয়! যেন টিম স্পিরিটের সঙ্গে সবাই এগিয়ে যেতে পারে। এখানে যেমন উসাইন বোল্ট, ফেলপস কিংবা মেসি-নেইমাররা খেলেছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের আব্দুল্লাহ হেল বাকি-রোমান সানারা খেলছেন। তারকা হওয়ার বড় মাধ্যমও এই প্ল্যাটফর্ম। অনেকেই হয়েছেন। আবার হবেনও।
প্রাচীণ গ্রীসে অলিম্পিকের গোড়াপত্তন। তবে ১৯০০ সালে আধুনিক অলিম্পিক শুরু হয়েছিল। শুরুতে ছিল ১৪টি দেশের প্রতিনিধিত্ব। আর ১২৪ বছরে তা বাড়তে বাড়তে ৩২টি খেলার ৩২৯টি ইভেন্টে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নেমেছেন ২০৬টি দেশের ১০ হাজার ৫০০ জন অ্যাথলেট। আধুনিক অলিম্পিকের স্বপ্নদ্রষ্টা পিয়েরে দ্য কুবার্তো বেঁচে থাকলে হয়তো অনেক খুশি হতেন। এত বছর আগে যে বড় স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তা সফলই।
তানাহলে রিফিউজি থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের এমন কোনও দেশ এখন বাকি নেই যারা অলিম্পিকে এসে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে না। যারা রিফিউজি, নিজেদের দেশ থাকতেও যাদের নেই, তাদের আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি এনিয়ে টানা তৃতীয়বার অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।
শুক্রবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই উদ্বাস্তু দলের পতাকা বহন করবেন সিন্ডি গাম্বা। ক্যামেরুনে জন্ম নেওয়া এই বক্সার বলেন, ‘আমাদের রিফিউজি অলিম্পিক টিম নামে ডাকা হলেও সারা বিশ্বের উদ্বাস্তুদের স্বীকৃতি আমরা পাবো। আমাদেরকে দেখা হবে একটি দল, অ্যাথলেট, যোদ্ধা, ক্ষুধার্ত অ্যাথলেট হিসেবে, যারা একটি পরিবারের অংশ। আমরা শুধু উদ্বাস্তু নই, আমরা অ্যাথলেট। লোকেরা আমাদের উদ্বাস্তু হিসেবে দেখবে, কিন্তু এখানে আসা অন্য দলগুলোর মতো আমরাও একই লক্ষ্য নিয়ে এসেছি। আমরাও জিততে এসেছি একই শক্তি ও ক্ষুধা নিয়ে।’ এমন সুযোগ আর কোনও খেলায় আছে কিনা সংশয় আছে।
শুধু কি রিফিউজি! ফিলিস্তিনের ওপর বর্বর নির্যাতন করে যাচ্ছে ইসরায়েল। এনিয়ে কতশত কথা। তারপরও অলিম্পিক কমিটি তাদের খেলায় বাধ সাধেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা অন্য কোনও দেশগুলোর মধ্যে যতই বৈরিতা থাকুক না কেন, অলিম্পিকে কোনও ছাড় নেই! অনেক সময় বড় জনসংখ্যা দেশ থেকে বড় বহর আসে। অনেক সময় ছোট দেশ থেকে কমের পাশাপাশি বড় সংখ্যাও থাকে।
এই যেমন ইউরোপের দেশ লিথুয়ানিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ২৭ লাখের মতো। সেখান থেকে ৫০ জন ক্রীড়াবিদ এসেছেন। ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্র থেকেও এসেছেন। কোথাও চার কিংবা পাঁচজন। আরও কম হতে পারে। বোল্ট-ফেলপসের সঙ্গে থেকে যদি অন্যরা উৎসাহিত হয়। কিছু শেখা যায়। সবাইকে এক কাতারে আনাটাই বড় বিষয়।
শুধু ক্রীড়াবিদ কেন, পাশাপাশি দর্শকরাও এই মিলনমেলায় সামিল হয়ে থাকেন। স্বাগতিক শহরটি নতুন করে জেগে ওঠে। এর জ্বলন্ত প্রমাণ প্যারিসের সিন নদী। দূষিত হয়ে পড়া নদীর পানি ঠিক করতেই বিপুল অর্থ বেরিয়ে গেছে। নদীতে প্রথমবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মানে শুধু ব্যতিক্রম কিছু করা নয়, পাশাপাশি বার্তাও রয়েছে। পুরো বিশ্বকে পরিবেশ ভালো রাখাটা যে বড় দায়িত্ব তাও মনে করিয়ে দেওয়া।
এক অলিম্পিক তাই অনেক কিছুর আগমনী বার্তা দিয়ে থাকে। প্যারিসে একটু পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে। বিশ্বের চোখও সেখানে। নিজ দেশের পতাকা নিয়ে সিন নদীর পাড়ে নিজেদের উপস্থিত জানান দেবেন সবাই। নতুন এক মিলনমেলার নামই যে অলিম্পিক গেমস, একে গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ কেন বলা হয়, তার মাহাত্ম্য নিশ্চয় বুঝতে পারছেন!