সিসি ক্যামেরাই সব নয়
হয়ে গেলো জেলা পরিষদ নির্বাচন। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাই মাঠ পুরোটাই ছিল শাসক দল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। তাই ৫৯টি জেলা পরিষদের নির্বাচনে ৪৯টিতেই চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। এর মধ্যে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন ২৫ জন। এরপরও ৯টি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা হেরেছে। আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় পেয়েছেন ৬ জন। এছাড়া জাতীয় পার্টির (জাপা) একজন চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। আর কোনও দলের সমর্থন ছাড়া স্বতন্ত্র ৩ জন প্রার্থী জয় পেয়েছেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়াল তার সহকর্মীদের নিয়ে কমিশনে বসে সিসিটিভি-তে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তবে গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচন যেমন বন্ধ করে দিয়েছেন সেটা তাকে করতে হয়নি। হয়তো প্রার্থীরা সচেতন ছিলেন বা প্রশাসনও কিছুটা সচেষ্ট ছিল নির্বাচনের পরিবেশ কিছুটা বজায় রাখতে।
এই সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত কমিশন। নির্বাচনি অপরাধ দমনে এই সিসি ক্যামেরা কতটা কাজে দেবে সে নিয়ে বড় আলোচনা চলছে। কোনও অপরাধ ঘটলে আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করে পুলিশ। এখন কমিশন পুরো লাইভ দেখছে, ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বর্তমানে অপরাধের কিনারা থেকে শুরু করে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ সব কিছুতেই রয়েছে সিসি ক্যামেরার ভূমিকা। সিসি ক্যামেরার ওপরে অনেকাংশেই নির্ভরশীল পুলিশ। প্রশ্ন হলো, সিসি ক্যামেরা কি পারবে নির্বাচনি অপরাধ কমাতে? উত্তরটা জটিল।
বলা হয়, মেশিনের পেছনে যে মানুষ থাকে তাদের ভূমিকা মেশিনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নির্বাচন যে মেশিনে হচ্ছে, গাইবান্ধায় আমরা দেখলাম তার সামনের মানুষগুলো কত বিপজ্জনক। তারা পুরও সিস্টেমকেই দখলে নিয়ে মেশিনকেও তাদের মতো ব্যবহার করেছে। যে সিসিটিভি নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এত উচ্ছ্বসিত সেটা নিয়েও তাই বহু শঙ্কা আছে।
প্রথমত: জাতীয় নির্বাচন হবে একইদিনে সারাদেশে ৩০০ আসনে। হাজারও কেন্দ্র, এর মধ্যে অনেক কেন্দ্র থাকবে শহর থেকে দূর বহুদূরে। সিসি ক্যামেরার সংখ্যা তাহলে কত লক্ষ হতে পারে?
ঢাকায় বসে এই লাখ লাখ সিসি ক্যামেরায় কিছুই বোঝা যাবে না। নির্ভর করতে হবে স্থানীয়দের ওপর। রিটার্নিং কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মী, নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত ভোটকর্মী এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কতটা অঙ্গীকারের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন, কতটা ভয়মুক্ত পরিবেশে কাজ করবেন সেটা সময়ই বলবে। অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের মতো যেকোনও সময় সিসি ক্যামেরাতেও সমস্যা হতে পারে। নষ্ট করে দেওয়াও অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। বর্তমানে বিদ্যুতের যে অবস্থা দেখছি, সেটাও একটা কারণ হতে পারে এই সিসি ক্যামেরা থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ার।
আমরা কি তাহলে নির্বাচন কমিশনকে একা করে ফেলছি? সবাই যার যার জায়গায় দায়িত্ব পালন না করে শুধু নির্বাচন কমিশনকে বলে দিচ্ছি তোমাকে ভালো নির্বাচন করে দেখিয়ে দিতে হবে। নির্বাচনের আসল খোলোয়াড় রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতারা। অথচ আমরা ভালো করেই জানি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার ক্ষেত্রে বড় বাধা নির্বাচন কমিশনের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতা। খোদ কমিশনও সেটাই বলছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি হলো, রাজনৈতিক দল ও নেতারা নিজেদেরই নিজেরা বিশ্বাস করে না, তাই তাদের অধীনে কোনও নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না বলেই তারা প্রচার করে।
নির্বাচনের সময় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা কতটা নিরপেক্ষভাবে ও শক্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে, সেটি আরেক বড় চিন্তা। কমিশন নিজেই গত ৮ অক্টোবর কিছুটা দেখতে পেয়েছে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে বৈঠকে। আর নির্বাচনে ইভিএমের (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) প্রতি বড় দল হিসেবে বিএনপি ও নাগরিক সমাজে অনাস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে এই মেশিনে কার্যকারিতা কীভাবে মানব সৃষ্ট দুর্যোগে নষ্ট হয় সেই মহড়ার সর্বশেষ ছিল গাইবান্ধা উপ-নির্বাচনে।
গণতন্ত্রের ভিত মজবুত না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। বিবাদ, বিদ্বেষের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চা করে নির্বাচনি ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা আনা যায় না। একটা সময় ছিল নির্বাচনি সহিংসতা হতো। এখন সারা বছরই চলে এই চর্চা। জিতলে সব, হারলে জীবনটাও থাকে কিনা সেই ভয়– এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছে আমাদের দলগুলো। তাই সাধারণ মানুষের কাছে নির্বাচন মানেই যথেষ্ট চাপ এবং উদ্বেগের। খারাপ রাজনীতির কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায় এবং নাগরিক স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নগুলো ক্রমে লঘু হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
তাই সিসি ক্যামেরায় একটি বা দুটি নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশনের সন্তুষ্টির জায়গা নেই। কমিশন কীভাবে তার ওপর রাজনৈতিক আস্থার সংকট কাটাবে, ইভিএমকে আস্থায় আনবে, পুলিশ ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে, নির্বাচনের সময় শান্তির পরিবেশ বজায় রাখবে, ভোটারদের জন্য ভয়মুক্ত নির্বাচনি আয়োজন করতে পারবে– এসব প্রশ্নের উত্তর নিজেরই আগে জানা থাকতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক