প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, বিশ্বে বিদ্যমান সব ভাষা সংরক্ষণের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের।‘আমি মনে করি, সারাবিশ্বে বিদ্যমান সব ভাষাকে সংরক্ষণ, এর ওপর গবেষণা করা এবং এগুলোর ইতিহাস জানা এই ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব।
মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) অপরাহ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২৩’ উপলক্ষে রাজধানীর সেগুন বাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন।শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান।আরও বক্তব্য রাখেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং ইউনেস্কো ঢাকা অফিসের অফিসার ইনচার্জ সুসান মারি ভাইজ। অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই বিশ্বের বিপন্ন ভাষাগুলো এখানে সংরক্ষণ এবং তার ওপর গবেষণা করা হোক। এই গবেষণার ওপরই আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ভাষা সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অনেক অবদান রাখতে পারে। এখানে যে কেউ যেকোনও ভাষা শিখতে চাইলেও আসতে পারবেন। ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।’
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে হিন্দুর ভাষা, আর উর্দুকে মুসলমানের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে, আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো মন মানসিকতার অধিকারীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের মানসিক দৈন্যতায় যারা ভোগেন, তাদের জন্যই ভাষার ইতিহাস ও উৎপত্তি স্থল জানা একান্তভাবে দরকার। এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বিশ্বের ১৬টি ভাষায় বহুভাষি পকেট অভিধান করার ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি মাতৃভাষা পিডিয়া তৈরির প্রকল্প গ্রহণ এবং ভাষা-সাহিত্যকর্ম, বাংলা অনুবাদ ও বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলন শীর্ষক একটি প্রামান্য চিত্র বিভিন্ন ভাষায় করার উদ্যোগ নেওয়ায় তিনি সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেখ হাসিনা ভাষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক’ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক পদক’ তুলে দেন। হাবিবুর রহমান ও রঞ্জিত সিংহকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মহেন্দ্র কুমার মিশ্র ও মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অব ওয়ার্ল্ড সোসাইটি, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সোসাইটির পক্ষে এর সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম পদক গ্রহণ করেন।
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার ‘বহুভাষিক বিশ্বে বহুভাষিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করে একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। এর আগে জাতীয় সংগীত এবং অমর একুশের সংগীত— আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি,’ পরিবেশিত হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আলজেরিয়া, জাপান, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের শিশুরা প্রধানমন্ত্রীকে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শুভেচ্ছা জানায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গবেষণার জন্য ফেলোশিপ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার এবং সেজন্য ফান্ড লাগলে আমি তার ব্যবস্থা করে দেবো। কারণ, আমি সবসময় গবেষণায় বেশি জোর দেই। গবেষণা ছাড়া কোনও বিষয়েই উৎকষর্তা সাধন করা যায় না। তিনি বলেন, ‘আজ আমরা খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি, তা গবেষণারই ফসল এবং ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর আবার সরকার গঠন করেই গবেষণায় গুরুত্ব আরোপ করে এবং বরাদ্দ দেয়। প্রথমে ১২ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বাজেটে ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়।’ তিনি এ সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য খাতে অধিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
যেসব এলাকায় স্কুল নাই তার সরকার সেসব এলাকায় স্কুল, প্রতিটি উপজেলায় সরকারি কলেজ এবং প্রতিটি জেলায় বিষয়ভিত্তিক বহুমুখী বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ও আওয়ামী লীগ সরকার করেছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি থেকে আরও কয়েকটি করে দেওয়া হয়েছে। কোন অঞ্চলে কী ধরনের মানুষজন এবং তাদের কী ধরনের শিক্ষার দরকার, তার ওপর ভিত্তি করেই আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষা এবং গবেষণার ওপর জোর দিয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশের অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক যে ইংরেজি ভাষাটা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমনভাবে চলে গেছে যে, শিক্ষা-দীক্ষাসহ সবকিছুতে এই ভাষাই পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে গিয়েছে। কিন্ত সেইসঙ্গে নিজের ভাষা শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। নিজের ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি অন্য যেকোনও একটি বা দুটি ভাষা আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখতে পারে। আর এখন ডিজিটাল যুগে ডিজিটালি ও শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।’
২০০১ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে নির্মাণ কাজ শুরু করলেও পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকার সেই কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন। পরবর্তী সময়ে আবারও সরকারে এসে নিজের মনের মতো করে ইনস্টিটিউটটি গড়ে তোলে বলেও জানান তিনি।
বাঙালি জাতি রক্ত দিয়ে মা ডাকার অধিকার পেয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সংস্কৃতির ওপর অনেক আঘাত আনা হয়। আমাদের ভাষা পাল্টে দিয়ে অন্য ভাষা তুলে ধরা হয়। তখন আজকের এই দিনে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়ে মা ডাকার অধিকার পেয়েছিল।’
ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের মানুষের কাজের সুবিধার জন্য আমরা ৯টি ভাষার একটি অ্যাপ করেছি। ডিজিটাল সিস্টেমে যে কেউ যেন ভাষা শিখতে পারে, আমরা সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
শিশুরা তাড়াতাড়ি ভাষা শিখতে পারে। তারা একসঙ্গে দুই-তিনটা ভাষা দ্রুত শিখে নেয়। তবে কোনটা ধারণ করবে সেটা আসে পরে। মাতৃভাষায় শিক্ষা হলে সবকিছু জানা, বোঝা ও উপলব্ধি প্রকাশ করার উপকার অনেক বেশি।’
এখন ফ্রিল্যান্সিংয়ের যুগ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ছেলেমেয়েরা এর মাধ্যমে টাকা উপার্জন করতে পারছে। আমরা তাদের লার্নিং এবং আর্নিংয়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তারা এখন একেবারে ইউনিয়নে বসে বিদেশে কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারছে।’
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করাচিতে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি শিক্ষা সম্মেলন করা হয়েছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করা হবে। এই খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে। তখন এভাবে প্রতিবাদ শুরু হয়। ভাষার জন্য আমাদের আন্দোলন, সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস উপস্থাপন করে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও বার বার কারাবরণ এবং কারাগার থেকেই ৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার সংগ্রামকে চূড়ান্ত রুপদানের বিভিন্ন খণ্ড চিত্রও তুলে ধরেন। খবর: বাসস