রাজারবাগের অনুসারীরা গোপালগঞ্জের নাম পরিবর্তন করে ‘গোলাপগঞ্জ’ করতে চায়: সিটিটিসি’র প্রতিবেদন
রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীদের প্রচার-প্রচারণার কারণে নানাভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে। পূর্ব নির্দেশনা অনুসারে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার পর রাজারবাগ পীরের অনুসারীদের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।
মামলার নির্ধারিত দিন হিসেবে রবিবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশের পর রাজারবাগ পীর ও অনুসারীদের জঙ্গি সম্পৃক্ততা নিয়ে তদন্তে নামে সিটিটিসির কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম। তদন্ত শেষে হাইকোর্টে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
গোপালগঞ্জের নাম পরিবর্তন করে ‘গোলাপগঞ্জ’ করা হয়
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজারবাগ পীর ও তার অনুসারীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের নাম বদলে গোলাপগঞ্জ করে তাদের আলোচ্য পত্রিকার (দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাত) মাধ্যমে প্রচার করছে। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে নূরানীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও জেলার নাম পরিবর্তন করে নূরগাঁও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাম পরিবর্তন করে আমানবাড়িয়া—এরকম আরও বেশ কয়েকটি জেলা ও স্থানের নাম পরিবর্তন করে তারা নিজেদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব সারাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ। মানুষের এই ধর্মানুভূতি কাজে লাগিয়ে এই পীর এবং তার দরবার শরিফ সামাজিকভাবে কুসংস্কার, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। পীর দিল্লুর রহমানের দরবার থেকে প্রকাশিত আলোচিত দুটি পত্রিকা ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ ও ‘দৈনিক আল ইহসান’-এর মাধ্যমে গুটি কয়েক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে নানাভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে। তাদের এসব কার্যক্রম সরাসরি সরকারি নীতিমালা, দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরোধী। দেশের বিভিন্ন থানায় রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর ও তার মুরিদদের বিরুদ্ধে রুজুকৃত মামলা ও মামলাগুলো তদন্তের ফলাফলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
সিটিটিসি’র প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়েছে, রাজারবাগ দরবারের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘দৈনিক আল ইহসান’ ও ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা, তাদের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত বিভিন্ন বই, ইতোপূর্বে তাদের কার্যক্রম এবং বিভিন্ন জেলায় তাদের অনুসারীদের কার্যক্রমের কারণে রুজুকৃত মামলা ও মামলাগুলোর তদন্তের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—তারা ইসলাম ধর্মের নামে এবং অনেক ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের খণ্ডিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে দেশের ধর্মভীরু মানুষকে ভুলপথে পরিচালিত করে। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা ও তথাকথিত জিহাদকে উসকে দিচ্ছে। এ দেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের মতবাদ প্রচার করছে ও কার্যক্রম চালাচ্ছে, রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর, তার সহযোগী ও অনুসারীদের কার্যক্রম জঙ্গিদের কার্যক্রমের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন মতাবলম্বী ও ভিন্ন ধর্মের মানুষকে, তাদের ভাষায় মাল’উনদের হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব উল্লেখ করে ফতোয়া এবং এক্ষেত্রে কতল করার আদেশ দিয়েছে—যা মূলত বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের মানুষকে হত্যা করার ফতোয়ার অনুরূপ। এটি ইসলামের নামে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর মতো একই প্রক্রিয়ায় বিরোধীদের অর্থাৎ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করার ও ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করার কৌশল। তাদের এ ধরনের বক্তব্য মানুষকে জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করবে, অসহিষ্ণু করবে, অসম্প্রদায়িক চেতনা নষ্ট করতে ভূমিকা রাখবে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, তাদের প্রচারণা ও অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে মূলত তারা দেশের হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং গণতন্ত্রবিরোধী একটি শ্রেণি বা গোষ্ঠী তৈরি করতে চাচ্ছে। তাছাড়া, তারা ছোঁয়াচে রোগবিরোধী ও বাল্য বিবাহের পক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য ও ফতোয়া দিয়ে ধর্মভীরু ও সহজ সরল সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
তাই সার্বিক পর্যালোচনায় সুস্পষ্টভাবে সিটিটিসির কাছে প্রতীয়মান হয় যে তারা এখনও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত না হলেও তাদের বিভিন্ন প্রকাশনা, বক্তব্য, মুরিদ ও অনুসারীদের প্রতি তাদের নির্দেশনার ফলে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। একইসঙ্গে তাদের এসব বক্তব্য ও প্রচার প্রচারণার কারণে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের ‘লোন উলফ’ হামলায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
ওই প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকায় রাজারবাগ দরবার শরিফ নজরদারিতে রাখতে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যা্ন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমকে (সিটিটিসি) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে হাইকোর্ট তার আদেশে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ-সিআইডি ও কাউন্টার টেরোরিজমের ইউনিটের প্রতিবেদনে জঙ্গি সম্পৃক্ততাসহ বেশ কিছু অভিযোগ ওঠায় রাজারবাগ দরবারের পীর দিল্লুর রহমানসহ তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা চাইলে মামলা করতে পারবেন বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোর তদন্ত চলাকালে পীর ও তার অনুসারীদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবেন বলেও আদেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দুদককে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলে আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
মামলার অন্যতম আইনজীবী এমাদুল হক বশির বলেন, এই মামলা করতে গিয়ে আমরা নিজেরাও অনেক হুমকির শিকার হয়েছি। রাজারবাগের পীর সিন্ডিকেট চলমান মামলায় প্রভাব বিস্তার করতেও নানানভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে।