গোঁড়া এই ইসলামী দলটির অপেক্ষাকৃত নরম নেতা হিসেবই বারাদারকে দেখে পশ্চিমারা। তালেবানের সঙ্গে চুক্তির সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন ফোনে, চুক্তিপত্রে সইও করেছিলেন এই বারাদারই।
২০২০ সালে কাতারের দোহায় স্বাক্ষরিত ওই চুক্তির আওতায় আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যরা চলে যাওয়ার ক্ষণেই ২০ বছর পর ঝড়ের বেগে দেশটির ক্ষমতা দখল করে তালেবান।
মিশন গুটিয়ে শেষ মার্কিন সৈন্যটি চলে যাওয়ার পর এখন এই ইসলামী গোষ্ঠী সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, আর তাতে বারদারই নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে দলটির সূত্রে জানা গেছে।
তালেবান সরকারের ‘নেতৃত্বে বারাদার, সঙ্গে ইয়াকুব, স্তানিকজাই’
যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর অভিযানের মুখে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ক্ষমতা হারানোর পর দোহায় তালেবান যে রাজনৈতিক দপ্তর চালাচ্ছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন বারাদার।
ক্ষমতা পুনর্দখলের পর আফগানিস্তানে ফিরে এসে নতুন সরকার গঠনে বিভিন্ন আফগান দল-উপদলের মধ্যে আলোচনায়ও তাকেই নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে।
কট্টর ধর্মীয় দল তালেবানে বারদারের গ্রহণযোগ্যতা পশ্চিমাদের কাছে বেশি হওয়ার কারণ ২০০১ সালে ক্ষমতা হারানোর পর তার তৎপরতা।
বলা হয়, তালেবানের পতনের পর দলটির যে ক্ষুদ্র অংশ পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে সমঝোতা করতে চিঠি দিয়েছিল, সেই দলে বারাদারও ছিলেন।
তালেবানের নেতৃত্বে এখন যারা
২০১৮ সালে দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির আলোচনায় তালেবান নেতারা। ফাইল ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্র আটকাল, যুক্তরাষ্ট্রই মুক্ত করল!
ক্ষমতা হারানো তালেবানের নেতা বারাদার ২০১০ সালে পাকিস্তানে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের নেতারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছিলেন। তখন বারাদারের পেছনে লেগেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা। এক পর্যায়ে করাচিতে তার অবস্থানের তথ্য তারা পেয়ে পাকিস্তানকে জানায়।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে করাচিতে যে অভিযানে বারদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাতে পাকিস্তানির বাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীও ছিল।
এরপর টানা আট বছর তিনি পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করতে যায়, তখন তাদের বারাদারকে প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই ২০১৮ সালে বারাদারকে মুক্তি দিতে হয় পাকিস্তানকে।
মুক্ত বারাদার সোজা চলে যান দোহায়, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় নয় সদস্যের তালেবান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই আলোচনায় নেতৃত্বে ছিলেন জালমে খালিলজাদ।
তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার। ফাইল ছবি। রয়টার্স থেকে নেওয়া
দুই বছরের আলোচনা শেষে চুক্তিতে তালেবানের পক্ষে সই করেন মোল্লা বারদার। এরপর প্রথম কোনো তালেবান নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে সরাসরি কথা বলেন তিনি।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, পাকিস্তান, চীনসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনায় বারদারই তালেবানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
তালেবানের আমির বা শীর্ষনেতা হায়বাতুল্লাহ আখুনজাদা তাদের প্রয়াত নেতা মোল্লা ওমরের মতোই সবসময় আড়ালে থাকেন। আর সেই কারণে বারাদারই দলটির প্রকাশ্য মুখ।
গত ১৫ অগাস্ট তালেবান কাবুল দখলের সময় দোহায় থাকা বারদার বলেছিলেন, “আফগানিস্তানে আমরা আবার বিজয়ী হব,
বরাবরের মতোই কালো পাগড়ী বেঁধে সাংবাদিকদের সামনে এসে তিনি বলেছিলেন, “দেশকে নিরাপদ রাখা এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আর এটাই এখন আমাদের জন্য পরীক্ষা।”
তালেবান নেতা মোল্লা বারাদার কাবুলে
আফগানিস্তানে ক্ষমতা পুনর্দখলের পর কাতার থেকে দেশে ফেরেন নেতা মোল্লা বারাদার (সামনে)। ছবি: রয়টার্স
‘ব্রাদার’ থেকে বারাদার
তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠদের একজন হিসেবেই পরিচিত বারাদার। বলা হয়, মোল্লা ওমরের ‘ব্রাদার’ হিসেবেই দলে সবাই মনে করত তাকে, তার অপভ্রংশ হিসেবে বারাদার যুক্ত হয় মোল্লা আবদুল গনির নামের পেছনে।
শীর্ষ অন্য তালেবান নেতাদের মতো বারাদারের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও খুব কমই জানা যায়।
দক্ষিণ আফগানিস্তানের উরুজগান প্রদেশে পশতুন গোত্রে ১৯৬৮ সালে বারদারের জন্ম বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তথ্য পাওয়া যায়। আবার তার জন্ম কান্দাহারে বলেও আরেকটি তথ্য মিলছে।
অন্য অনেক আফগানের মতো গত শতকের ৭০ এর দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই বারদারের লড়াইয়ের হাতেখড়ি।
জনশ্রুতি আছে, সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি মোল্লা ওমরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল, তখন মোল্লা ওমর ১৯৯৪ সালে তালেবান গঠন করেন।
কান্দাহারে যে মাদ্রাসা থেকে তালেবানের উৎপত্তি, তা প্রতিষ্ঠার সময় মোল্লা ওমরের সঙ্গে বারদারও ছিলেন। তাদের মধ্যে আত্মীয়তার খবরও বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া যায়।
এরপর যুদ্ধ চালিয়ে ১৯৯৬ সালে তালেবানকে ক্ষমতায় নিতে মোল্লা ওমরের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বারদার। সেই সরকারে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে উপমন্ত্রীর পদে ছিলেন তিনি।