সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩৩ অপরাহ্ন

বুদ্ধিজীবী হত্যা: দেশকে মেধাশূন্য করার মহাপরিকল্পনা

আবদুল মান্নান / ১৩৩ বার
আপডেট : মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১

বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে ১৯৭১ সালের ২৫/২৬ মার্চ রাতে শুরু হয়নি। পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকায় আলোচনার নামে তামাশা করছিলেন ঠিক তার পেছনে চলছিল বাঙালি নিধনের অন্য আর এক খেলা। ২৫ মার্চের এক সপ্তাহ আগে থেকে পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ বিভিন্ন সেনানিবাসে গিয়ে সিলগালা করা খামে সেনানিবাসের প্রধানে হাতে একটা খাম তুলে দিয়ে এসেছিলেন, যেখানে ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ বিস্তারিত পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনার মূল অংশে ছিল কোথায় কখন প্রথম আক্রমণটা করতে হবে এবং বাঙালি হত্যার শুরুটা  কীভাবে করতে হবে। পাকিস্তানি শাসকদের মূল্য লক্ষ্য ছিল ‘আমাদের মানুষের দরকার নেই, মাটি হলেই চলবে ’।
২৫ মার্চ মধ্যরাতের ঠিক আগে যখন অপারেশন সার্চ লাইট শুরু  হলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রথম লক্ষ্য ছিল নির্বিচারে বাঙালি হত্যা। যদিও এই অপারেশনের শুরুটা হয়েছিল ঢাকায়, কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে, বিশেষ করে যেখানে সেনানিবাস ছিল সেসব শহরে তা শুরু হয় সেনানিবাসের অভ্যন্তরে বাঙালি সেনাবাহিনীর সদস্যদের হত্যা করার মাধ্যমে। হত্যাযজ্ঞের প্রথম রাতে টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর ধারণা ছিল, ১৯৪৭ পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলায় যত সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে তার মূলে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর শিক্ষকরা। যদিও ধারণাটি সত্য, বাস্তবটা হচ্ছে, সব আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই আন্দোলনের সূত্রপাত যারা করেছিল, তারা তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল। সম্পৃক্ত করতে পেরেছিল দেশের সাধারণ জনগণকে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয়ের পেছনে এই দেশের ছাত্রদের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আরও ধারণা ছিল এই শিক্ষার্থীদের ‘মগজ ধোলাই’ এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন বাঙালি শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা। সুতরাং এই দেশের এই তেজস্বী তরুণদের খাঁটি পাকিস্তানি বানানোর জন্য শুরুতেই এই শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের খতম করতে হবে। আরও একটি বিষয় তারা শুরুতেই উপলব্ধি করেছিল যে শেষতক হয়তো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আর রাখা যাবে না। তারা এই উপসংহারে উপনীত হন, যদি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েও যায় তাহলে একটি নতুন দেশ গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে মেধাবী মানুষের। সেই মেধাবী মানুষদের যদি শেষ করে দেওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাস্তবে তা হবে একটি বিকলাঙ্গ রাষ্ট্র। স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে সেই দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় মেধাবী মানুষের। আর কোনও দেশে তার ঘাটতি হলে সেই দেশে তার প্রশাসন থেকে শুরু করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হয় মেধাবী মানুষের সহায়তা ও পরামর্শ। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা শিক্ষা-দীক্ষায় যেন সবসময়  পিছিয়ে থাকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী  সেই চেষ্টাই  করে। সুতরাং পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে চেষ্টা করবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেকোনও দেশে বুদ্ধিজীবীরা হলেন দেশটির বিবেক, সাধারণ মানুষকে সত্য আর ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেন তারা। এই কাজটি বাংলাদেশে সবসময় হয়েছে।
বাংলাদেশে  বুদ্ধিজীবী হত্যার যে কর্মযজ্ঞ একাত্তরের ২৫ মার্চ শুরু হয়েছিল তা সারা বছর ধরে চলেছে এবং তার একটি ভয়াবহ পর্যায় ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে, ১৪ ডিসেম্বর আর তা করার দায়িত্ব পালন করেন জামায়াত ইসলামের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের (ছাত্রশিবিরের আগের নাম)  ঘাতকরা। একসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার কাজটির দায়িত্ব অর্পণ করে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ঘাতক বাহিনী ইসলামী ছাত্রসংঘের  হাতে। নয় মাসে সারা দেশে কত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে’ ২০৭ শহীদ বুদ্ধিজীবী কথা বলা হয়েছে। ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ’ নামে এক সরকারি প্রকাশনায় ৯৬৮ জন শিক্ষক ও ৪১ জন আইনজীবীর শহীদ হওয়ার তথ্য উল্লেখ আছে। এদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী, লেখক, কবিসহ বিভিন্ন পেশাজীবী।
এই কাজটি প্রধানত তদারকি করতেন পাকিস্তানি সেনা অফিসার জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর জামায়াতের পক্ষ থেকে এই দায়িত্বটা নিয়েছিলের ছাত্রসংঘের নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, যাকে বেগম জিয়া তার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়েছিলেন।
তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে, গণহত্যার  প্রথম প্রহরেই শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেশের সেরা ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেই যে বুদ্ধিজীবী ও বাঙালি নিধন শুরু হলো, তা পরবর্তী নয় মাস লাগামহীনভাবে চলেছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে এই পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য জামায়াতের ইসলামির ছাত্রসংগঠন ছাড়াও কাজে লাগিয়েছে এ দেশে বসবাসরত বিহারি বা অবাঙালি  সম্প্রদায়কে। তাদের সহায়তা করেছে মুসলিম লীগের ঘাতক বাহিনী ‘আল শামস’, যাদের নিয়ন্ত্রণ করতেন চট্টগ্রামের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী)।
আওয়ামী লীগের সদস্য ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এসব ঘাতক বাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ও বুদ্ধিজীবী। এই সাকা চৌধুরী নিজ হাতে খুন করেন তার নির্বাচনি এলাকায় দানবীর কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের স্বত্বাধিকারী নূতন চন্দ্র সিংহকে। বাদ যাননি সাকা চৌধুরীদের বাড়িতে যে গৃহশিক্ষক তার বোনকে  প্রাইভেট পড়াতেন, চট্টগ্রাম কলেজের দর্শনের অধ্যাপক অবনি মোহন দত্ত।
১৯৭১ সালে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনার সূত্রপাত যুদ্ধের একদম শেষ সময়ে, ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর। ছাত্রসংঘের ঘাতকরা তাদের পরাজয় অবধারিত জেনে তাদের শেষ  হত্যা মিশন শুরু করে। একটি কাদামাটি লাগানো মাইক্রোবাস নিয়ে সারা ঢাকা শহর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চষে চোখ বেঁধে তুলে আনে দেশের বেঁচে যাওয়া সেরা সন্তানদের, যাদের অনেকেই ছিলেন তাদের শিক্ষক বা পরিচিত শিল্পী অথবা সাহিত্যিক। আনা হয় মোহাম্মদপুর সংলগ্ন শারীরিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। বাঁধা হয় তাদের হাত আর চোখ। পেছনে রায়েরবাজারের পরিত্যক্ত ইট ভাঁটায় তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। বিজয়ের দু’দিন আগে কী নির্মম আর অমানবিক একটি ঘটনা!
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তানি বাহিনী মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশ ফিরলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ১২ তারিখ গঠিত হলো নতুন মন্ত্রিসভা। একটি নতুন দেশের সূচনার সময় বিভিন্ন পদে পদায়ন করার জন্য যে মানের মানুষ প্রয়োজন, তাদের ঘাটতি দেখা দিলো। যেমনটি চেয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এই দেশীয় দোসররা। কেমন ছিল সেই সময়ের বাংলাদেশ, তা পঞ্চাশ বছর পর এসে বর্ণনা করা কঠিন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ওই সময়ে অবসরে গিয়েছেন এমন অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে বঙ্গবন্ধু খুঁজে বের করে কাজে লাগালেন। এটি সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর যোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে।
পঞ্চাশ বছর পর এসে যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন বুঝতে পারি, বাংলাদেশ আজ যেখানে দাঁড়িয়ে তা সম্ভব হতো না। এই দিনে ১৯৭১ সালে আমাদের যেসব বুদ্ধিজীবী ঘাতকদের হাতে শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক।  


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর