বাহিনী গড়ে প্রকাশ্যে অপকর্ম করতো রিমন
বেগমগঞ্জে সন্ত্রাসীদের গুলিতে বাবার কোলে থাকা শিশু তাসফিয়া আক্তার জান্নাতের (৪) মৃত্যুর পর প্রধান অভিযুক্ত মো. রিমনের (২৫) বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য মিলেছে। স্থানীয়রা জানান, অভিযুক্ত রিমন, মহিন, রহিম, সুজন, বাদশাহ এবং আকবর এলাকায় আগে থেকেই মাদকদ্রব্য বিক্রি ও যৌন হয়রানিসহ নানান অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় থানায় অভিযোগ দিয়েও কোনও সুফল মেলেনি। স্থানীয় রাজনীতিকদের আশীর্বাদে এরা কাউকে তোয়াক্কা করতো না। পুলিশ জানায়, রিমনের বিরুদ্ধে থানায় আটটি মামলা ছিল। যার প্রায় সবগুলোই চাঁদাবাজি ও মারামারি ঘটনার।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. জসিম বলেন, শিশু জান্নাত হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত মো. রিমন কাউকে মানতো না। সে এলাকায় প্রকাশ্যে গাঁজা এবং ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রি করতো। স্কুলে যাওয়ার সময় ছাত্রীদের ওড়না ধরে টান দিতো, ইচ্ছে করে মেয়েদের ল্যাং মেরে ফেলে দিতো, প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি করতো। কেউ তাকে বাধা দেওয়ার সাহস পেতো না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সব জানলেও অধিকাংশ সময় কোনও ব্যবস্থা নিতো না।
হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য তাসলিমা আক্তার বলেন, রিমন, মহিন ও রহিমসহ ২০-২৫ জন এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতো। এরা শিশু তাসফিয়ার হত্যাকারী।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, রিমন ও তার সহযোগীরা সরাসরি দলীয় কোনও পদ-পদবিতে নেই। তবে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। এ কারণে এলাকার মানুষজনও তাদের ভয়ে পেতো, মুখ খুলতো না।
স্থানীয় মতিন মিয়া বলেন, রিমন ও তার সহযোগীরা এলাকায় প্রকাশ্যে গাঁজা ও ইয়াবার ব্যবসা করে। এলাকাবাসীর মধ্যে কোনও ঘটনা ঘটলে তারা একটি পক্ষের হয়ে অন্য পক্ষের ওপর চড়াও হতো। বাড়িঘরে হামলা, জিম্মি করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তাদের কাজ। রিমন বাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলে কথা বললেই, তার ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসতো। এদের কাছে কেউ নিরাপদ নয়।
এদিকে সম্প্রতি রিমনের চাচা বাদশাহ মিয়া স্থানীয় খুরশিদ আলমের জমির মাটি কেনেন। তবে চুক্তির বিপরীতে বেশি মাটি কেটে নেওয়ার চেষ্টা করলে বাধার মুখে পড়েন বাদশাহ। পরে তিনি ভাতিজা রিমনকে ডেকে আনেন।
খুরশিদ আলমের ভাই মো. ফিরোজ আলম বলেন, ‘গত শুক্রবার (৮ এপ্রিল) বাদশাহ জমির ক্ষতি করে মাটি তোলার চেষ্টা করে। আমরা তাকে বাধা দেই। তাকে বলি এটা কোনও সামাজিকতা না। এ সময় স্থানীয় সাগর নামে এক ব্যক্তি ঘটনা মিটমাট করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে বাদশাহ রিমনসহ তার সহযোগীদের ফোন করে ডেকে নিয়ে আসে। তারা এসে আমার শার্টের কলার চেপে ধরে। তখন আমার চার মেয়ে এগিয়ে এলে তাদের ওপরও সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। তারা আমার অন্তঃসত্ত্বা এক মেয়ের পেটে লাথি মারে।’
ফিরোজ আলম আরও বলেন, ‘হামলায় রিমন, মহিন, সুজন, রহিম, বাদশাহ এবং আকবর সরাসরি অংশ নেয়। এরা সবাই এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তারা আমাকে ধমক দিয়ে দোকানের দিকে যেতে বলে। কিন্তু মেয়েরা আমাকে দোকানে যেতে দেয়নি। সন্ধ্যায় সাগরসহ অন্যদের নিয়ে বসে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করি। সে অবস্থাতেও সন্ত্রাসীরা আমার ঘর লক্ষ্য করে তিন-চারটি ককটেল নিক্ষেপ করে। আমাদের লক্ষ্য করে গুলিও করা হয়। কোনোরকমে আমাদের জান বাঁচে। তাদের পিস্তলের খোসা আমি পুলিশ কর্মকর্তা জসিমের কাছে তুলেও দিয়েছি।’
এ ঘটনায় শনিবার (৯ এপ্রিল) বেগমগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। ফিরোজ আলম বলেন, ‘আমি অভিযোগপত্র লিখে থানায় ওসির কাছে যাই। ওসি মামলা না নিয়ে আমাকে বলেন, মামলার দরকার নেই। সেদিন যদি মামলা নিয়ে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে গত ১৩ এপ্রিলের ঘটনা ঘটতো না। শিশু জান্নাতকে গুলি খেয়ে মরতে হতো না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, বুধবার (১৩ এপ্রিল) রাতে শিশু জান্নাতের খুনিরা লতিফপুর রমিজ উদ্দিন হাজী বাড়ির একটা খামারে অবস্থান করছিল। একাধিকবার বেগমগঞ্জ মডেল থানার ডিউটি অফিসারকে ফোন করে জানিয়েছি। তারা যদি তখন ফোন পেয়ে আসতো সেখান থেকে আসামিদের ধরতে পারতেন। তারা আসছি, এলে পাবো কিনা, এসব বলে সময়ক্ষেপণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত আসেননি।
হাজিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহ আজিম মির্জা বলেন, হাজীপুর সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে একাধিকবার প্রশাসনকে জানানে হয়েছে। এখানে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক অত্যাধিক হারে বেড়ে গেছে। এলাকার চিহ্নিত অপরাধীরা প্রকাশ্যেই তাদের অপকর্ম করে বেড়ালেও, প্রশাসন অনেকটাই নীরব ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, পুলিশ ও র্যাবকে দুদিন আগেও সন্ত্রাসী রিমন ও তার সহযোগীদের গ্রেফতারে অনুরোধ করেছি। তার সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছি। কিন্তু তারা আমার অভিযোগে আমলে নেননি।
তবে নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকারের পাশাপাশি সম্প্রতি রিমনের বিষয়ে কোনও অভিযোগ পাননি বলে দাবি করেছেন বেগমগঞ্জ মডেল থানার ওসি মীর জাহিদুল হক রনি। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করেনি। থানায় লিখিত কোনও অভিযোগও আসেনি। এছাড়া সন্ত্রাসীদের অবস্থান জানাতেও কেউ ফোন করেনি। আসামিদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান ওসি। তবে তিনি বলেন, ‘রিমনের বিরুদ্ধে থানায় এর আগে আটটি মামলা আছে।
তিনি বলেন, শিশু তাসফিয়া হত্যার ঘটনায় ১৭ জনকে আসামি করে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় মামলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।