পূর্ব লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে বিগস-লুৎফুর-রাবিনার ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

যুক্তরাজ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বৃহস্পতিবার (৫ মে)। এবারের নির্বাচনে বিভিন্ন কাউন্সিলে রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করছেন। তবে মেয়র পদে সরাসরি নির্বাচনে কেবল বাঙালিপাড়া টাওয়ার হ্যামলেটসে দুই বাংলাদেশি প্রার্থী লড়াইয়ে আছেন। ফলে সেখানকার নির্বাচনের দিকেই চোখ যুক্তরাজ্যের প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশির।
লেবার পার্টির ‘সেফ সিট’ হিসেবে পরিচিত এ এলাকার দুই এমপি রুশনারা আলী ও আফসানা বেগম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তারা দুই জনই লেবার পার্টির প্রার্থীর পক্ষে মাঠে রয়েছেন। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি এ বারায় বসবাস করেন। মূল ধারার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে রয়েছেন বাঙালি কমিউনিটির মানুষজন।
টাওয়ার হ্যামলেটসের বর্তমান মেয়র লেবার পার্টির জন বিগসের সঙ্গে এবার লড়াইয়ে রয়েছেন দুই বারের মেয়র লুৎফুর রহমান এবং তার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ অনুসারী রাবিনা খান। রাবিনার এক সময়ের নেতা লুৎফুর রহমানের অনেকটা নিরাপদ জয়ের আশায় ছাই ঢেলে তিনি নিজেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। ফলে বিগস-লুৎফুর-রাবিনার ত্রিমুখী লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মেয়র পদে শুরুতে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা থাকলেও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। জন বিগসের সঙ্গে লুৎফুরের লড়াই সেকেন্ড চয়েসের ভোটে গড়ালে শেষ মুহুর্তে সব সমীকরণ পাল্টে যেতে পারে,এমন মত স্থানীয়দের।
যুক্তরাজ্যের কোনও কাউন্সিলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরাসরি ভোটে নির্বাচিত মেয়র ছিলেন সিলেটে জন্ম নেওয়া লুৎফুর রহমান। ২০১০ ও ২০১৪ সালে দুই বার স্বতন্ত্র ও নিজের দল টাওয়ার হ্যামলেটস ফাস্ট থেকে নির্বাচন করে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। পরে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে তাকে মেয়র পদ ছাড়তে হয়। পরের দুই মেয়াদে নির্বাচনে অংশ না নিতে আদালত তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।নির্বাচনি প্রচারণায় লেবার পার্টির রহিমা রহমান
গত দুইটি নির্বাচনে লুৎফুর নিজে প্রার্থী না হতে পারায় যথাক্রমে রাবিনা খান ও অহিদ আহমদকে সমর্থন দিলেও তারা লেবার পার্টির জন বিগসের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন। লুৎফুরবিহীন গত দুই নির্বাচনে ব্যালটের ফলাফলের সমীকরণ জানিয়ে দেয়, লেবার পার্টির শক্ত ঘাঁটি টাওয়ার হ্যামলেটসে লুৎফুর রহমান ছাড়া আর কোনও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
এমন বাস্তবতায় দীর্ঘ আট বছর পর এবার নিজে সরাসরি ভোটের লড়াইয়ে নামার সুযোগ পেয়েছেন লুৎফুর। মেয়র থাকা অবস্থায় নানা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এবং গত দুই মেয়াদে বারার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বাজেট কাট ও বিভিন্ন সেবা বন্ধের বিষয়টি সামনে এনে প্রচারণা চালাচ্ছেন লুৎফুর রহমান। এবার তিনি প্রার্থী হয়েছেন এস্পায়ার নামে স্থানীয় একটি দল থেকে। মূলত নিজের ব্যাক্তি ইমেজ ও জনপ্রিয়তাই তার শক্তি। লেবার পার্টির মেয়র প্রার্থী টানা দুই বারের মেয়র। শ্বেতাঙ্গ এই প্রবীণ রাজনীতিকেরও বাঙালি পাড়ায় রয়েছে নিজস্ব ভোট, জনপ্রিয়তা।
এবার টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতা, কয়েকজন সাংবাদিকের স্ত্রীকে মনোনয়ন দিয়েছে লেবার পার্টি। ২০১০ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে এখানে বাংলাদেশি কমিউনিটির মূল ধারায় প্রকাশ্যে ‘লুৎফুর বিরোধিতা’ দৃশ্যমান ছিল না। কিন্তু এবারের নির্বাচনে লেবার পার্টির কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে প্রচারণার নানা ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতারা ভিন্ন কৌশল নেন। লুৎফুরের মেয়াদকালে কাঙ্ক্ষিত মূল্যায়ন বঞ্চিত কমিউনিটি নেতা, সংবাদকর্মীদের স্যোশাল মিডিয়াসহ সরাসরি লুৎফুর বিরোধিতায় মাঠে নামাতে পারা এবারের নির্বাচনের মাঠে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
লুৎফুর ভোটে মেয়র নির্বাচিত হলে টাওয়ার হ্যামলেটসে তাকে সরিয়ে আবার প্রশাসক বসানো হবে। একটি মহলের পক্ষ থেকে এমন গুজবও ছড়ানো হচ্ছে কমিউনিটিতে। এর বিপরীতে নতুন ভোটারদের কাছে টানতে প্রচারণায় নতুনত্ব, চমক বা বিরোধীদের সমন্বিত প্রচারণার যুৎসই জবাব দৃশ্যমান হয়নি লুৎফুর রহমানের পক্ষে, এমন মতামতও রয়েছে তার প্রতিপক্ষের।
লন্ডনের সাবেক মেয়র ক্যান লিভিংস্টন ও টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক লেবার ডেপুটি লিডার পলা মঞ্জিলা উদ্দিন লুৎফুরকে সমর্থন দিলেও বিরোধীরা জবাবে বলছেন, ক্যান লিভিংস্টোন বয়সের ভারে ন্যুজ। পলা মঞ্জিলা উদ্দীন আর্থিক কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। এখনকার রাজনীতিতে তাদের কোনও ধরনের পদবি বা অবস্থান নেই।
অন্যদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে এখানে কনজারভেটিভ পার্টি থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী থাকলেও এবার কনজারভেটিভ পার্টি থেকে বাংলাদেশি কোনও প্রার্থী না থাকায় কিছুটা হলেও সুবিধা পাবেন লুৎফুর। এমন ধারণা অনেকের।
২০১৮ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে লেবার পার্টির টিকিটে বর্তমান মেয়র জন বিগস পেয়েছিলেন ৪৪ হাজার ৮৬৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দী রাবিনা খান পেয়েছিলেন পেয়েছেন ১৬ হাজার ৮৭৮ ভোট।
যুক্তরাজ্যের মতো দেশের রাজনীতিতে বড় রাজনৈতিক দলের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে টিকে থাকা যায় না। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে হারিয়ে যাবার অসংখ্য উদাহরণকে পাশ কাটিয়ে ব্যতিক্রম হিসেবে লুৎফুর লেবার পার্টি ছেড়ে দুই বার মেয়র হয়েছেন। এরপর তাকে প্রার্থী হতে আদালত নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় গত দুই বার এখানে জিতেছেন লেবার পার্টির জন বিগস।
টানা দুই মেয়াদে এ বারায় লেবার পার্টির মেয়র থাকা অবস্থায় সেবামূলক অনেক খাতে বাজেট কাট এবং কিছু নাগরিক সেবা বন্ধের কারণে সরাসরি কোনও দলীয় সমর্থক নন, এমন স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশই হতাশ। এই হতাশা এবং লুৎফুরকে বরখাস্ত করার বিষয়টিতেও ভোটারদের সহানুভূতি নিজের পক্ষে কাজে লাগাতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন লুৎফুর রহমান। কারণ তিনি ও তার সমর্থকরা জানেন, বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে হারলে শুধু টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতি থেকে নয়, সমাপ্তি ঘটবে তুমুল আলোচিত এক লুৎফুর রহমান অধ্যায়েরও।
লুৎফুর রহমানের ঘনিষ্টজন, সাবেক ডেপুটি মেয়র অহিদ আহমদ বলেন, লুৎফুর ভাই তো সরল মনে অনেক নতুন অনভিজ্ঞদের বড় বড় পদবী, এমনকি স্বামী-স্ত্রীকেও টাওয়ার হ্যামলেটসে শুধু নমিনেশন দিয়ে কাউন্সিলর নয়, কেবিনেট মেম্বার এমনকি মেয়র প্রার্থীও বানিয়েছিলেন। তারাই আজ তার প্রতিপক্ষ হয়ে নির্বাচন করছেন। সুদিনে পাশে থাকা বসন্তের কোকিলরা ভিড়ে গেছে ভিন্ন শিবিরে। অহিদ বলেন, ২০০৮ সাল থেকে শুরু থেকে লুৎফুর রহমানের সঙ্গে ছিলাম, এখনও আছি। তবে নিজের বিবেকের সঙ্গে আপোস করে কোনও দিন রাজনীতি করবো না। লুৎফুর রহমান একজন নেতা,একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানেই তিনি সেখানেই মানুষের ঢল নেমেছে। মিথ্যাচার আর চরিত্র হননের অপতৎপরতার জাল ছিঁড়ে তিনি বিজয় ছিনিয়ে আনবেন। শেষ পর্যন্ত লুৎফুর এবার মেয়র হতে পারবেন কি-না এ প্রশ্নের জবাব পেতে অপেক্ষা করতে হবে শুক্রবার সকালে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত।