নতুন ইসি গঠনে বাছাই: পুরনো পথেই সার্চ কমিটি
নির্বাচন কমিশন গঠনে আইনি কাঠামোর এবং আইনি কাঠামোবিহীন সার্চ কমিটির কার্যক্রমে নতুনত্ব কিছু দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। নতুন ইসি গঠনের সুপারিশ চূড়ান্ত করতে আগের দুটি সার্চ কমিটির পথ ধরেই হাঁটছে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সার্চ কমিটি। আইনে সার্চ কমিটির যে কার্যপরিধি নির্ধারণ করা আছে, তা আইন তৈরির আগের দুটি কমিটির চেয়ে খুব একটা রকমফের নেই। অবশ্য সার্চ কমিটির কাছে জমা পড়া নামের তালিকা প্রকাশের বিষয়টিকে ইতিবাচক ও কিছুটা ব্যতিক্রম মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। এটা সম্ভব হলে তা আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হবে বলে তারা মনে করেন। এদিকে দুটি সার্চ কমিটির তুলনায় বর্তমান কমিটি কিছুটা চাপে রয়েছে বলেও সার্চ কমিটির মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া বিশিষ্টজনেরা মন্তব্য করেন।
উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালে সার্চ কমিটি যে ১০ জনের নাম সুপারিশ করেছিল, সেই কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালনকারী তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদ সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূইঞা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়ার পরপরই সেই নামগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। তবে, সার্চ কমিটির কাছে তখন যেসব নামের তালিকা এসেছিল সেটা প্রকাশ হয়নি। একই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে সার্চ কমিটির দেওয়া ১০ জনের তালিকা মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম প্রকাশ করলেও সার্চ কমিটিতে জমা পড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হয়নি।
এদিকে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ইসি গঠনের লক্ষ্যে ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিলেও ওই বছর তারা সার্চ কমিটিতে কোনও নামের তালিকা পাঠায়নি। ২০১৭ সালে তারা সংলাপে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি সার্চ কমিটিতে তাদের পছন্দের তালিকাও পাঠায় দলটি। তবে এবার দলটি রাষ্ট্রপতির সংলাপেও অংশ নেয়নি। সার্চ কমিটিতে কোনও তালিকা দেয়নি। বিএনপি জোটের শরিক কয়েকটি দল এবার সংলাপে অংশ নিলেও সার্চ কমিটিতে কোনও তালিকা দেয়নি।
নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে নতুন আইন হওয়ার আগে দুটো নির্বাচন কমিশন সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত হয়। ২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি চার সদস্যের এবং ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি হয়। দুটো সার্চ কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপনে তার কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি উল্লেখ করা ছিল।
২০১৭ সালের সার্চ কমিটির প্রজ্ঞাপনে ন্যূনতম একজন নারীসহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে, সভায় উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুই জন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করার কথা ছিল। এতে সিদ্ধান্তের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা ছিল। ওই সময় ১০ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করার কথা ছিল। ২০১২ সালে কেবল নারী সদস্য সুপারিশের নির্দেশনা ছাড়া অন্যান্য কার্যপরিধি একই রকম ছিল।
এদিকে এবার সার্চ কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২ অনুযায়ী, দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। নতুন এই আইনে সার্চ কমিটির দায়িত্ব কর্তব্যও প্রায় আগের সার্চ কমিটির মতোই নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনে আগের ১০ কার্যদিবসের পরিবর্তে ১৫ কার্যদিবসে সুপারিশ চূড়ান্ত করার কথা বলা রয়েছে। আর এই কমিটি রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে বলে আইনে বলা আছে।
প্রসঙ্গত, আগের সার্চ কমিটিতে এই বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও তারা নিজেদের মততো করে রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে তালিকা নিয়েছিল। পেশাজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করেছিল।
বিগত (২০১৭) সার্চ কমিটির সদস্য অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, সার্চ কমিটির কার্যক্রমে এখনও পর্যন্ত কোনও নতুনত্ব দেখা যায়নি। গতবার আমরা যে প্রক্রিয়ায় এগিয়ে ছিলাম এবারও সেটা অনুসরণ করা হচ্ছে। আগেরবারও আমরা বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। যে কথাগুলো এবার বলা হচ্ছে, সেটা গতবারও বলা হয়েছিল। তবে এবার একটা নতুন বিষয় দেখছি, তা হলো— নামের তালিকা প্রকাশের বিষয়টি সামনে এসেছে। ৩২৯টি যে নাম প্রস্তাব এসেছে, তা প্রকাশের অনুরোধ এসেছে। মোটামুটি যেটা শুনলাম এটা মেনে নেওয়া হতে পারে। এটা হলে মানুষ বুঝতে পারবেন, কাদের থেকে বেছে নেওয়া হলো। এটা সম্ভব হলে খুবই ভালো হবে। আর এটা হবে আগের দুই সার্চ কমিটির থেকে কিছু ব্যতিক্রম, যা নতুন কমিশন বাছাইয়ে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হবে। এটা হলে ব্যক্তিগতভাবে আমি আনন্দিত হবো। নির্বাচন কমিশনে আগেরবার প্রথমবারের মতো নারী সদস্য যুক্ত হয়েছেন। এবার নারীর পাশাপাশি দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকবে, তিনি এমন আশা প্রকাশ করেন। ব্যক্তিগতভাবে সার্চ কমিটির প্রতি আস্থা থাকার কথা উল্লেখ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, আমি আগেরবার সার্চ কমিটির সদস্য ছিলাম। সেই কমিটিতে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানও সদস্য ছিলেন। তাকে দেখেছি, প্রো-অ্যাক্টিভ ভূমিকা পালন করতে। আশা করছি, তার নেতৃত্বে এই কমিটির কাছ থেকে ভালো কিছু আমরা পাবো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রবিবার সার্চ কমিটির বৈঠকে অংশ নেওয়া সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘কার্যক্রম তো অনেকটাই একই ধরনের। তবে আমাদের মনে হয়েছে, গত দুইটি সার্চ কমিটির তুলনায় বর্তমান কমিটি কিছুটা চাপে আছে। ২০১৭ সালের সার্চ কমিটির মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেন, তারা কী আগের পথে যাচ্ছেন, নাকি নতুন কোনও পথে যাচ্ছেন, সেই প্রশ্ন আমারও ছিল। তারা কী প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হবেন, কীভাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে, তা জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কতটা হবে তা নিশ্চিত নই। তবে একটা বিষয় ভালো যে, তারা যে নামগুলো পেয়েছে তা প্রকাশ করবে। এ বিষয়ে আমাদের দাবি হচ্ছে— ঢালাওভাবে নাম প্রকাশ না করে কোন দল কোন সংগঠন, কার নাম দিয়েছে, সেটা প্রকাশ করতে হবে।
সার্চ কমিটির সঙ্গে মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বর্তমানে আইনের মোড়কে অনেকটা একই ধরনের অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে। আশা করি, এই কমিটি তার কাজের মাধ্যমে তার গ্রহণযোগ্যতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। স্বচ্ছতার নীতি অনুসারে বিভিন্নভাবে পাওয়া প্রস্তাবিত নাম থেকে যাদের বাদ দেওয়া হলো ও যাদের নেওয়া হলো, এ সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করে তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এগুলো দুরূহ বিষয় না। এ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার চরম সংকটকালে একটি যোগ্য ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনে অনুসন্ধান কমিটি সর্বোত্তম সিদ্ধান্তটি নিতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, সার্চ কমিটি সবার নাম প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছেন। আলী ইমাম মজুমদার রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোন দল কার নাম দিয়েছে সেটা প্রকাশ করতে বলেছেন। আমি তার বিরোধিতা করেছি। এটা বলেছি, সবার নাম প্রকাশ হতে পারে। কিন্তু কোন দল কার নাম দিয়েছে তা প্রকাশ করা ঠিক হবে না। এটা হলে ওই ব্যক্তিরা মার্কা হয়ে যাবেন।
বর্তমান সার্চ কমিটির সদস্য ছহুল হোসাইন বলেন, সার্চ কমিটির গঠন ও কাজের পরিধি অনেকটা আগের মতেই। তবে এবার আইনের মধ্যে হওয়ায় কিছুটা ভিন্নতা তো আছেই। আগেরবার আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সার্চ কমিটির বৈঠকে অংশ নিয়ে আমি মতামত দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে অন্যদের মতামত শুনছি। আমাদের অনেক কাজ করতে হচ্ছে। আশা করি, একটি ভালো কমিশন গঠনের জন্য যোগ্য ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করতে পারবো।
এদিকে সংসদের প্রধানবিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশের আগে ১০ জনের নামের তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে সার্চ কমিটির সুপারিশ করা তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়ার আগে জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে।’
রবিবার ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি রাষ্ট্রপতিতে চিঠি দিয়ে সার্চ কমিটি থেকে যে ১০ জনের সুপারিশ পাবেন, তা প্রকাশের অনুরোধ জানিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, অনুসন্ধান কমিটির দেওয়া নাম প্রকাশে আইনে কোনও বাধা নাই। রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন মনে করলে নামগুলো যাচাই-বাছাই করার জন্য জাতীয় সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতাসহ অন্য দলের সদস্যরা আছেন, পাঠাতে পারেন। এর ফলে একদিকে যেমন জনগণ বিষয়টি অবহিত হতে পারবে, কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে পাঠানো হলে জাতীয় সংসদের সংশ্লিষ্টতাও হবে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এবারই প্রথম নতুন আইন অনুযায়ী সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারি সংসদে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ পাস হয়। এরপর ২৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি আইনটিতে সম্মতি দেন। পরে ৩০ জানুয়ারি এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশিত হয়।
আইনের আলোকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি নতুন ইসি গঠনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক হলেন— সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী এবং সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোহরাব হোসাইন। গঠনের পরদিনই ৬ ফেব্রুয়ারি সার্চ কমিটি নিজেরা বৈঠক করেন। এরপর তারা দেশের বিশিষ্টজনের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক দল ও ইচ্ছুক সাধারণ মানুষের কাছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে প্রত্যাশিতদের নামের তালিকা সংগ্রহ করেছেন।