বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৪৮ অপরাহ্ন

জিয়ার কবর নিয়ে রাজনীতি

রিপোর্টার / ১৫৬ বার
আপডেট : মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০২১

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের সর্বশেষ নির্বাচনের প্রায় ২ বছর আগে সংসদ ভবন এলাকা থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের কবর স্থানান্তরের কথা উঠেছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রায় ২ বছর আগে জিয়ার কবর নিয়ে একই বিতর্কের জন্ম হয়েছে দেশের রাজনীতিতে। সে কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, জিয়ার কবর সত্যি সত্যি সরানো হবে, নাকি বিএনপিকে চাপে রাখতে রাজনীতির অংশ? অবশ্য সেখানে জিয়ার লাশ আদৌ আছে কিনা সে বিতর্ক নতুন নয়, ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পরেই বিদ্যমান সংসদে আওয়ামী লীগ এমপি এবং সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা আসাদুজ্জামান খান এই প্রশ্ন তুলেছিলেন।

নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। ১৭ আগস্ট ২০২১ ঢাকার শেরেবাংলা নগরে চন্দ্রিমা উদ্যান ও সংলগ্ন এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে এ ধরনের সংঘর্ষের জন্য পুলিশ ও বিএনপি পরস্পরকে দায়ী করেছে। পুলিশ বলেছে, বিএনপি কর্মীরা অতর্কিত হামলা করেছে পুলিশের ওপর। আর বিএনপি বলছে পুলিশ বিনা উসকানিতে এ হামলা চালিয়েছে। মহানগর বিএনপির নবনির্বাচিত নেতাদের জিয়ার কবরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে সংঘটিত এই ঘটনাটি দলীয় কোন্দলে নাকি পুলিশের উসকানিতে বলা মুশকিল।

ওই ঘটনাকে ইঙ্গিত করে ১৯ আগস্ট আওয়ামী লীগের শোক দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে যে মারামারি করলো বিএনপি, তারা জানে না যে ওখানে জিয়ার লাশ নেই? তারা তো ভালোই জানে। তাহলে ওই নাটক করলো কেন তারা? খালেদা জিয়াও খুব ভালোভাবে জানে।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর আ ক ম মোজাম্মেল হক, ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, শাজাহান খান, মাহবুব উল আলম হানিফসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা একই সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন।

তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা হবে সরকারের জন্য আত্মঘাতী এবং দেশের মানুষ সেটি মানবে না। মির্জা ফখরুল ২৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চন্দ্রিমায় যে জিয়ার মরদেহ রয়েছে সেই সাক্ষী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নিজের কাঁধে জিয়ার মরদেহ বহন করেছেন সে সময়ের এই সেনা অধিনায়ক।

অবশ্য এর আগেই দলীয় অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় খোদ এরশাদের কাছ থেকেই এ তথ্য শোনা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়া বা তারেক জিয়া কি বলতে পারবে তারা লাশ দেখেছে? গুলি খাওয়া লাশ তো দেখাই যায়। তারা কি দেখেছে কখনও বা কেউ কি কোনও ছবি দেখেছে কখনও? দেখেনি। কারণ, ওখানে কোনও লাশ ছিল না। ওখানে একটা বাক্স আনা হয়েছিল। সেখানে ওই বাক্সের ফাঁক দিয়ে যারা দেখেছে, সেই এরশাদের মুখ থেকেই শোনা, কমব্যাট ড্রেস পরা ছিল। জিয়াউর রহমান তখন প্রেসিডেন্ট। সে তখন কমব্যাট ড্রেস পরে না। এটা কি বিএনপির লোকরা জানে না?’

প্রেসিডেন্ট এরশাদ এখন বেঁচে নেই। তাই প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে এরশাদের হ্যাঁ-না জবাব জানার সুযোগ নেই আমাদের। জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে নতুন করে আলোচনার মধ্যে ২৯ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, জিয়ার কবর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে সরানো হবে। তিনি জিয়ার কবরে লাশ নেই বলে থামেননি। বলেছেন, ‘সেই কবরে যদি কোনও কিছু থেকে থাকে, তার ডিএনএ টেস্ট করে প্রমাণ করুন। যদি প্রমাণ হয় (জিয়ার লাশ রয়েছে), জাতির কাছে নাকে খত দিয়ে ক্ষমা চাইবো।’

আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই নেতা বলেন, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় জিয়ার কবরসহ লুই কানের নকশাবহির্ভূত সব স্থাপনা অপসারণ করতে হবে এবং এ বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। স্থাপনার মধ্যে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারের বাড়িও পড়ে, সে ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা পরিষ্কার করা হয়নি।

সবকিছু মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, জিয়ার কবর সরানো নিয়ে ‘কথার হাট’ বসেছে শুধু। কবর স্থানান্তর কোথায় হবে, কখন হবে, কেন হবে তার কোনও সুনির্দিষ্ট কথাবার্তা এখনও সরকারি ভাষ্যে আসেনি। যদি এরকম কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সরকারের কাছে থাকে তবে তার যথাযথ ব্যাখ্যা সাধারণ্যে প্রকাশ করা দরকার। কবর স্থানান্তর ধর্মীয় দৃষ্টিতে নাজায়েজ কোনও বিষয় নয়। মরহুম হজরত মুফতি ফয়জুল্লাহ (রা.) একবার বলেছিলেন, কোনও কবরে মুরদা দাফন করার ৭ বছর পর তার ওপর বাড়িঘর করাও জায়েজ আছে। এ বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই, ইসলামি স্কলাররা সেটা বিশ্লেষণ করে ফতোয়া দিতে পারেন।

তবে ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৩৮ সালে ফোরাত নদীর অনতিদূরে থাকা দুই জন সাহাবার কবরও প্রয়োজনে স্থানান্তর করা হয়েছিল। উভয় সাহাবার দেহ অক্ষত ছিল। এমনকি যে কাপড় দিয়ে উভয় সাহাবাকে দাফন করা হয়েছিল সে কাপড় পর্যন্ত মলিন হয়নি। এই দৃশ্য দেখে বহু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক তাৎক্ষণিক মুসলমানও হয়েছিলেন। প্রয়োজনে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবার কবর স্থানান্তর সম্ভব হলে জিয়ার কবর স্থানান্তরে অসুবিধা কোথায়? রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে তা হতেই পারে। লাশ থাকলেও হতে পারে। তবে জিয়ার কবর যদি সরানো হয় তবে দ্বিতীয়বার তাকে কোথায় সমাহিত করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার পরিবারের মতামত নেওয়া প্রয়োজন।

১৯৬০ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান বাংলাদেশের মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতা মনোভাবের উন্মেষ ঘটছে দেখে পূর্ব পাকিস্তানে সেকেন্ড ক্যাপিটাল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এবং তার নামকরণ করা হয়েছিল শেরেবাংলা নগর। পাকিস্তানের জেনারেল রাও ফরমান আলী তার বইতে লিখেছেন, আইয়ুব খান তাকে নাকি বলেছিলেন, ‘দৃষ্টিনন্দন সংসদ ভবনটি তৈরি করেছিলাম বাঙালি আমাকে যাতে মনে রাখে’। বাঙালি আইয়ুবকে কতটা মনে রেখেছে তা জানি না, তবে তিনি ২০০ একর জমি নিয়ে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ একটি সংসদ ভবন বাঙালিকে দিয়েছেন– এটা এখন অনেকে জানেন।

সংসদ ভবনের কাজ যখন প্রায় শেষ তখনই বাংলাদেশের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু সংসদ ভবনের অসম্পূর্ণ কাজটা শেষ করেছিলেন এবং ১৯৮২ সালে এরশাদ শাসনামলে এটি খোলা হয়। মূল নকশায় থাকা চন্দ্রিমা উদ্যানে নাকি সচিবালয় হবে। সংসদের পাশে সচিবালয় থাকা যৌক্তিকও। চন্দ্রিমা উদ্যানে যদি সচিবালয় হয় তবে জিয়ার কবর তো একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেই। তখন কবর সরানোর প্রশ্ন আসবেই। সুতরাং এটি নিয়ে তর্কবিতর্ক না করে রাজনৈতিক সমাধানে আসা উচিত।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর