রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৫৯ অপরাহ্ন

ক্ষমতার যাত্রাপালার ‘চরিত্রহীন’ চরিত্ররা

রিপোর্টার / ৩২০ বার
আপডেট : রবিবার, ১ আগস্ট, ২০২১

নাটক বা সিনেমায় ‘চরিত্রহীন চরিত্র’ বলে একটা কথা আছে। যে প্রতিদিন পেটের দায়ে অভিনয় করতে যায়, তাকে হয়তো কোনদিন উকিল বা চোর এর ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়। তাকে হয়তো কোনদিন হতে হয় অফিসের বস কিংবা যৌনকর্মীর দালাল। ঘরে ফিরলে কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় সে বন্ধুর চরিত্রটা কী? নচিকেতার গানে যেমন আছে- ‘যে মেয়েটা রোজ রাতে বদলায় হাতে হাতে তার অভিশাপ নিয়ে চলাই জীবন’, তো বদলানোর প্রতিটা বাঁকে সেই মেয়েটার ‘রোজগেরে অভিনয়’টা কেমন? মেয়েটার সাথে চরিত্র শব্দটা যুক্ত হয়নি একারণে যে অনেক দর্শনে এটা বলা হয়- পেটের দায়ে যারা যৌনব্যবসায়ে নামতে বাধ্য হন, তারাই নাকি সবচেয়ে সৎ এবং চরিত্রবান! নিজের কাজটা নাকি তারা সবচেয়ে ভালোভাবে করেন। বেঁচে থাকা ছাড়া তাদের আর কোন উচ্চাভিলাস সহসা থাকে না। রাজনীতির অভিনেতা বা ‘অতিনেতা’রা কেমন? রাজনীতিকে জড়িয়ে ঘরে কিংবা বাইরে তাদের ‘চরিত্র’ কেমন?

স্বাধীনতার পর থেকে বদলে যাওয়া রাজনীতি এবং ১৯৭৫ এর ষড়যন্ত্রের আখ্যানে মানুষের তুলিতে আঁকা প্রধান দুই চরিত্রের নাম তাজউদ্দীন আহমদ এবং খন্দকার মোশতাক। জাতির পিতা সপরিবারে  নিহত হলেন, তার বুলেটবিদ্ধ দেহ পরে থাকলো তার ইতিহাসময় বাড়ির সিঁড়িতে। জাতির পিতা নিজের কন্যা ও পুত্রদের যার ওপর ভরসা করতে বলেছিলেন- সেই খন্দকার মোশতাক বিশ্বাসঘাতকতার সিঁড়ি বেয়ে গেলেন ক্ষমতায়! রাজনীতির চরিত্রগুলো মনে হয় এমনই, সেখানে ক্ষমতাই শ্রেণি বা চরিত্র তৈরি করে। আর ক্ষমতার তুলি যে ক্ষমতাহীন তাকে হয়তো আঁকতে চায় না সহসা। তাই বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে মোশতাক গংয়ের সাথে যোগ না দেওয়ার অপরাধে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব.)মনসুর আলী এবং মো.কামারুজ্জামানরা প্রাণ দিতে বাধ্য হন জেলখানায় বন্দি থাকার পরও। সম্ভবত এ চরিত্রগুলো রাজনীতির অশ্রুজলে আঁকা। ক্ষমতার তুলি সবসময়ই রঙিন, অশ্রুজলের কোন রঙ ছিল না কোনও কালে।

রাজনীতির আরেকটা চরিত্রের নাম ‘পারিষদ চরিত্র’। বাবু যত বলে ‘পারিষদ’ দলে বলে তার শতগুণ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ফারুক-রশীদ-ডালিম-মোশতাক ছাড়াও তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বা মাহবুবুল আলম চাষীদের নামও উচ্চারিত হয়। ক্ষমতার বলয়কে ঘিরে থাকা এইসব আমলা কিংবা বর্তমানের কথিত কিছু বুদ্ধিজীবী অথবা যে কোনও মোড়কে জড়ানো ‘দালাল’দেরও একটা রাজনৈতিক চরিত্র থাকে। যে কোনওভাবে হোক ক্ষমতার ‘খুদ খাওয়া’টাই আসল। মোটিভ বা উদ্দেশ্য দিয়েই চরিত্রের গতিপথ বোঝা যায়। ক্ষমতার সাথে না থাকার ভীতিও কাজ করে কারো কারো ভেতর। ক্ষমতার তুলিতে আঁকা মানুষগুলোর চরিত্র ক্ষমতা বদলালে বেশিরভাগ সময় বদলে যায়। ক্ষমতাবৃক্ষের ছায়া ছাড়া এসব পরগাছা বা ‘চরিত্রহীন চরিত্র’রা লতাগুল্ম হয়ে জড়িয়ে থাকতে পারে না। বটগাছও ঝুরিমূল কিংবা লতাপাতাকে আশ্রয় দেয় হয়তো অজান্তে কিংবা একাকিত্ব কাটাতে অথবা এদের অন্যকাজে ব্যবহার করতে।

পারিষদের মতো রাজনীতির আরও একটা চরিত্র ছিল যার নাম ‘পেশিমানব’। পাড়া মহল্লায় এরা ‘গুন্ডা’ বা ‘মাস্তান’ হিসেবেই পরিচিত ছিল। রাজনীতির ভাষায় এরা ‘ক্যাডার’। হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ এর বাকের ভাই পাড়ার মাস্তান, কিন্তু চাঁদাবাজি যেন তাদের অভ্যাসে নেই। যদিও বাকের ভাই জানেন- ‘মাইরের উপর ঔষধ নাই’। রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা বিরোধীদের বা পাড়া মহল্লার বিপক্ষ দলকে হয়তো ‘মাইরের’ উপরে রাখতেই পছন্দ করেন। স্বাধীনতার পর থেকে এই ‘গুন্ডা বা ক্যাডার’ চরিত্র রাজনীতিকে ভুগিয়েছে অনেক। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে পাড়া মহল্লার গুন্ডা থেকে ঢাকা বা ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় নির্ভর গুন্ডারা একধরনের ‘নেতিবাচক’ জনপ্রিয়তার উপর ভর করে রাজনীতি করতেন।

একদা ছাত্রলীগের ক্যাডার খ্যাত হেমায়েতউল্লাহ-আওরঙ্গের (পরে এমপিও হয়েছিলেন) পরে জাতীয় পার্টির আজম খান, ছাত্রদলের সানাউল হক নীরু, গোলাম ফারুক অভি কিংবা ইলিয়াস আলীসহ একাধিক ক্যাডার চরিত্র রাজনীতির নিয়ামক হয়ে উঠেছিলেন। অভি ও ইলিয়াস এমপি হয়েছিলেন। তবে অভি ও ইলিয়াস গ্রুপের দ্বন্দ্ব এবং খুনোখুনির ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রায় নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ক্ষমতা কেন্দ্রিকতা ও প্রশাসন নির্ভর পদক্ষেপ (র‌্যাব, পুলিশ ও মামলা নির্ভরতা) নেওয়ার কারণে রাজনীতির এই ক্যাডার চরিত্রও গুরুত্ব হারাতে থাকে। কোন আসনই হয়তো খালি থাকে না। এই একই চরিত্র খানিক বদলে যায়, উঠে আসে আলোচনায় রাজনীতি নির্ভর কিছু ‘চরিত্রহীন চরিত্র’। গত দশ বছরে এসব ছোট বা মাঝারি আকারের ‘চরিত্রহীন চরিত্রের’ তালিকা লম্বা হয়েছে, আলোচনায় উঠে এসেছে ক্যাসিনো খ্যাত সম্রাট, জিকে শামীম, ‘রিজেন্ট’ খ্যাত সাহেদ, পাপিয়া এবং আওয়ামী চাকরীজীবী লীগ খ্যাত হেলেনা জাহাঙ্গীর।

ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে যে ক্যাসিনো ছিল, রাতভর ধুন্দুমার জুয়া খেলা হতো, সকালে ক্লাবগুলো ঘুমাতো, ক্যাসিনো দিয়ে যে ক্লাব কালচারই বদলে দিয়েছিলেন সম্রাট, তা যেন জানতোই না প্রশাসন। ধরা পড়ার পর বের হতে থাকলো সম্রাটের ‘কুকীর্তি’ আর মানুষ ভাবতে লাগলো প্রশাসন বা সাংবাদিকরা এতোদিন কোথায় ছিলেন? কেউ কী কিছু জানতেন না? সব দোষ যেন নিজের কাঁধে নিয়ে জেলে গেলেন সম্রাট আর যারা তাদের প্রশ্রয় দিতেন,সম্রাটের কাছে মাসোহারা নিতেন, তারা রয়ে গেলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই।

সম্রাটকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল নাটকীয়ভাবে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের একটি বাড়ি থেকে, ভারত সীমান্তের প্রায় কাছে ছিল যেটি (র‌্যাবের ভাষ্যমতে)। এমন নাটকীয়ভাবেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ‘রিজেন্সি’ খ্যাত সাহেদ-কে। সে ইন্ডিয়া পালানোর ঠিক আগ মুহূর্তেই সিনেমার দৃশ্যের মতো যেন তাকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে আইন-শৃংখলা বাহিনী, এমন একটা ‘ফ্লেভার’ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে ছবি তুলে সেটাকে ব্যবহার করে নিজেকে কেউকেটা প্রমাণ করা, টেলিভিশন টক শোতে অংশ নেওয়াসহ আরও অনেক কিছু করে দেখিয়েছেন সাহেদ। হতে পারে সেটা কাগজপত্র বা লাইসেন্স ছাড়া হাসপাতাল চালানো কিংবা করোনাভাইরাসপরীক্ষা বা চিকিৎসার নামে প্রতারণা। কিন্তু কতো টাকার সম্পদ সে অর্জন করেছিল? কতো টাকা সে প্রতারণা করে আয় করেছিল? সেসব কী এক-দেড়শো কোটি টাকার বেশি? যারা হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে তারা কই? সাহেদের মতো চরিত্রহীন চরিত্রের মানুষদের দিয়ে কী বড় রুই কাতলদের আড়াল করা হচ্ছে? এটাও কী রাজনীতির এক ‘আড়াল চরিত্র’? জিকে শামীম এমন আরেক চরিত্র। কতটাকা পাওয়া গেছে তার বাসা থেকে? কতোটাকার অস্ত্র, মদ বা জুয়ার যন্ত্রপাতি?

বাংলা ও হিন্দি ছবির বাস্তবতায় এমন ছবি হাজার খানেক হয়েছে যার সারমর্ম এই- কেউ সন্ত্রাসী হয়ে জন্মায় না, সমাজ তাকে সন্ত্রাসী হতে বাধ্য করে। ছবিতে এসব সন্ত্রাসীদের গ্লামার দেওয়া হয়। সিনেমা শেষে প্রেমিকা, বাবা-মা বা ভাই-বোনদের সহায়তায় সে সন্ত্রাসী শেষমেষ ভালো হয়ে যায়। এই লেখাতেও সম্রাট, জিকে শামীম কিংবা সাহেদদের গ্লামারাইজ বা তাদের প্রতি করুণা দেখানো হচ্ছেনা, শুধু আপামর জনসাধারণের যে প্রশ্ন তাদের দুই-একটা তুলে ধরা হচ্ছে।

 

এক. সাহেদ, সম্রাট বা জিকে শামীমরা বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামী করলে তারা সাহেদ, সম্রাট বা শামীম হতে পারতো কিনা?

দুই. ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ এর সেই অমর ডায়ালগ- ‘এভরি বডি ইজ ইকুয়াল বাট সামবডি ইজ মোর ইকুয়াল’ কথাটা কি বাংলাদেশের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য নয়?

তিন. হাল আমলে দেশের বড় এক শিল্পপতির ছেলেকে পুলিশ অভিযোগের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। শামীম, সাহেদ এবং সম্রাটের কপালে কেমন বিচার অপেক্ষা করছে?

চার. পাপিয়া কিংবা হেলেনা জাহাঙ্গীর রাজনীতির এক ধরনের নতুন ‘চরিত্র’। হেলেনার ফেইসবুকীয় কান্না, ফেইসবুকে নেতা-কর্মী চেয়ে পোস্ট, গ্রেপ্তারের সময় হাসিমাখা মুখ এসব রাজনীতিতে এক ধরনের নেগেটিভ ব্যঞ্জনা, যা দেখে এক শ্রেণির মানুষ মশগুল থাকতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে কারা তাকে রাজনীতিতে নিয়ে এলো এবং কাগজপত্রবিহীন আইপি টিভি চালাতে সাহায্য করলো? আর এদেশে যারাই গ্রেপ্তার হয় সবার বাসায় কী বিদেশি মদ থাকে?

এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে সময় লাগবে। কেউ কেউ হয়তো ধারণা করতে পারেন, রাজনীতি কিংবা রাষ্ট্র এদের কোথায় নিয়ে যাবে। সাহেদ, পাপিয়া, শামীম, সম্রাট কিংবা হেলেনা আসলে কোন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন? নায়ক, ভিলেন, ভ্যাম্প নাকি নিচুমানের চরিত্র? ক্ষমতার রাজনীতি আসলে কিভাবে তাদের তৈরি করলো এবং তাদের শেষ পরিণতিটা কী? একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করেছেন- “শিশু লীগ, জেলে লীগ, ভিক্ষুক লীগ বা চাকরিজীবী লীগের মতো অনেক সংগঠনের নাম শোনা গেছে। সাহেদ, সম্রাট, জিকে শামীম, পাপিয়া বা হেলেনা জাহাঙ্গীর জেলে বসে ‘আওয়ামী কয়েদী লীগ’ নামে একটা নতুন অঙ্গ-সংগঠনের পরিকল্পনা হাতে নিতে পারেন।”

ক্ষমতা ছাড়া এখন আর কোন নির্ভরতা যেন নেই, নেই কোন নতুনত্ব কিংবা সৃষ্টিশীলতা। ক্ষমতা তোমাকে জেলে নিলেও তুমি বেরিয়ে আসবে একদিন, হয়তো পুরোনো সঞ্চয় দিয়ে বাকি দিনগুলো চলে যাবে ভালো। ক্ষমতার যাত্রাপালায় তাই চরিত্রহীন ‘সঙ’ চরিত্র নিয়েও আলোচনায় থাকা যায়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর